ইন্টারপোলের মাধ্যমে কি শেখ হাসিনাকে ফেরানো সম্ভব?
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:২৮ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:৩৮
ঢাকা: জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে। এই রেড নোটিশ জারির মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনতে চায় সরকার। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করলেই কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব?
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধুমাত্র নোটিশ জারি করে কাউকে ফেরত আনা সম্ভব নয়। তাছাড়া শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। এখন ভারত যদি বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ফেরত দেয় সেক্ষেত্রে বিষয়টি খুব সহজ। কিন্তু ভারত না চাইলে শুধু নোটিশ দিয়ে ফেরত আনা সম্ভব নয়। কারণ, শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। নভেম্বরে ভারত সরকার নিশ্চিত করে যে, শেখ হাসিনা সেখানেই অবস্থান করছেন। তিনি কিন্তু সেদেশে বন্দি নেই। তাই বন্দিবিনিময় চুক্তিও খুব একটা কাজে আসবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকার ইন্টারপোল শাখায় সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) যোগাযোগ করলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর একটা চিঠি পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে ইন্টারপোলে পাঠানো হয়। সেই চিঠিটি ইন্টারপোলের সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। সদর দফতর এটি দেখভাল করছে। তবে এখনো রেড নোটিশ জারি করা হয়নি।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফরমালি আমাদের পক্ষ থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু চলে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দফতরে।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই। সেক্ষেত্রে একদিকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক আসামি, অন্যদিকে ভারতের কাছে একজন আশ্রয়প্রার্থী। কিন্তু বন্দিবিনিময় চুক্তিতে কারাগারে থাকা আসামি বা গ্রেফতার আসামির কথা বলা হয়েছে। বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনা পড়বে কি না তা নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেড এলার্ট মানে অমুক লোকের বিরুদ্ধে আমাদের এখানে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে। ওই আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের পুলিশ বিভাগকে তার ওপর নজর রাখতে বলবে।’
বাংলাদেশের ইন্টারপোল শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত আনা গেছে। আর বর্তমানে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটের রেড নোটিশের তালিকায় বাংলাদেশের ৬৪ জনের নাম রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি।
ইন্টারপোলের সহযোগিতায় শেখ হাসিনাসহ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে কি না? জানতে চাইলে নূরল হুদা বলেন, ‘এটা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। ফেরত পাঠানোর বিষয়টা শুধু রেড নোটিশের মাধ্যমেই সম্ভব হয় না। সেই দেশের জুডিশিয়াল অথরিটিরও বিষয় রয়েছে।’
সাবেক অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও বলছেন, ইন্টারপোলে কাউকে রেড এলার্ট দিলেই যে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে বিষয়টি তা নয়। যার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তাকে যে দেশে নেওয়া হবে সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন। কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না, সেগুলোও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।
এর আগে, ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার পর আযাদ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। তাকে ফেরত আনতে রেড এলার্ট জারি করেছিল ইন্টারপোল। ইন্টারপোলের তালিকায় এখন যে ৬৪ জনের নাম আছে সেখানে আবুল কালাম আযাদের নামও দেখা গেছে। কিন্তু আযাদকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।
যেভাবে কাজ করে ইন্টারপোল
ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেটি সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ও সমন্বয় করে। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। যেন বিশ্বের সব পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করতে পারে।
যদি একটি দেশের আসামি সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই আসামিকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে। সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডাটা বিশ্লেষণ, সেইসঙ্গে পলাতকদের খুঁজতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়।
তবে ইন্টারপোল কোনো আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না। যদি কোনো দেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোল সদর দফতরে আবেদন করে তাহলে ওই অভিযুক্তের অপরাধবিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলা কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে দিতে হয়।
ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে, তার বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করা হবে কি না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়। ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়।
মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেজ রয়েছে যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন: অপরাধীর ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন ও জালিয়াতির তথ্য ইত্যাদি পাওয়া যায়। দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার, অস্ত্রপাচার, মাদকপাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।
বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকলেও শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ইন্টারপোলে রেড নোটিশের আবেদন কেন
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই। চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়, বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, অথবা দেশের আদালতের কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয় তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত।
এই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যেকোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশকিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল সেটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০ এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
গত মাসেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ ৪৫ বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকার পরও শেখ হাসিনাকে সেই চুক্তি অনুযায়ী না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা কেন চাওয়া হচ্ছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যর্পণ চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। আর ইন্টারপোলের মাধ্যমে দ্রুত কাউকে ফেরত পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য যত প্রক্রিয়া আছে সব প্রক্রিয়াই ফলো করবে সরকার।’
তবে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় কোনো দেশ যদি কোনো আসামিকে ফেরত দিতে না চায়, তাহলে যেকোনো কারণ দেখিয়ে আবেদন নাকচ করে দিতে পারে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোটা দাগে বললে, প্রত্যর্পণ চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি শুধু আইনি নয়, রাজনৈতিকও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের জায়গা থেকে শেখ হাসিনাকে চুক্তি কিংবা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেক জটিল।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম
ইন্টারপোল জারি পুলিশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি বাংলাদেশ ভারত রেড নোটিশ শেখ হাসিনা