ঝুরি পিঠায় জীবন চলে যমুনাপাড়ের নারীদের
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০৮ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০১:৩২
সিরাজগঞ্জ: গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার ঝুরি পিঠা, যার স্বাদের ভক্ত ছেলে-বুড়ো সবাই। সেই ঝুরি পিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের যমুনাপাড়ের ভাঙন কবলিত কয়েক শ পরিবার। বিশেষ করে এসব পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য সহায় হয়ে এসেছে এই পিঠা। যমুনার পেটে সব হারিয়ে যখন তারা নিঃস্ব, তখন চালের কুঁড়োয় ঝুরি পিঠা তাদের দেখিয়েছে বেঁচে থাকার পথ।
শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম হাটপাঁচিল। গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার দুপাশের ফাঁকা জায়গায় তাকালেই চোখে পড়বে, সারি সারি কাপড় বিছানো। আর তার ওপর রোদে শুকোচ্ছে ঝুরি পিঠা।
স্থানীয়রা জানান, একসময় ঘর-বাড়ি ও জমিজমা ছিল তাদের সবার। এখন মাথা গোঁজার মতো ঠাঁইটুকু নেই তাদের। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করছেন যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষগুলো। কেউ অন্যের জায়গা ভাড়া নিয়ে বসবাসের জন্য গড়ে তুলেছেন ছোট ঘর। ছোট এই গ্রামেই তৈরি ঝুরি পিঠার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বর্তমানে হাটপাঁচিল গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের অন্তত এক হাজার নারী-পুরুষ ঝুরি পিঠা তৈরিতে যুক্ত। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই ঝুরি পিঠা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বছরের অধিকাংশ সময় এই ঝুরি পিঠা তৈরি হলেও ওয়াজ মাহফিল ও মেলার আধিক্য থাকায় শীতকালে এর চাহিদা বেশি। এ কারণে শীতকালকে এই পিঠাটি তৈরির প্রধান মৌসুম হিসেবে ধরা হয়।
ঝুরি পিঠা তৈরিতে যুক্ত কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। চুলার ওপর বড় একটি পাতিলে পানি গরম করে এতে পরিমাণমতো আতপ চালের গুঁড়া ও লবণ দিতে হয়। এরপর সেগুলো সেদ্ধ করে তৈরি করা হয় খামির। এ পর্যায়ে খামির থেকে ছোট ছোট বল আকৃতির দলা তৈরি করা হয়। সেই দলাগুলো ঝাঁঝর বা মাটির ছাঁচের ওপর ঘষে ঘষে কাঁচা ঝুরি তৈরি করা হয়। পরে সেই ঝুরি তিন-চার দিন রোদে শুকানো হয়। এরপর বাড়িতে রান্নাঘরে চুলার আগুনে নারীরা বালু দিয়ে ভেজে খাবারের উপযোগী করে থাকেন ঝুরি পিঠা। পরে সেগুলো মাটির পাত্রে মজুত করা হয় বিক্রির জন্য।
বাড়ির পাশের উঠানে ঝুরি পিঠা শুকাচ্ছিলেন তানিয়া খাতুন (৩২)। তিনি বলেন, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মিলে ঝুরি তৈরির কাজ করেন। এতে যা উপার্জন, তা দিয়ে পরিবারের খরচ চলে যায়। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করেন তিনি। সবাই মিলে দিনে ৮০ কেজি ঝুরি তৈরি করতে পারেন।
আমিনা খাতুন, শেফালী বেগম, জোবেদা খাতুনসহ আরও কয়েকজন নারীর সবাই ঝুরি পিঠা তৈরি করে থাকেন। তারা বলছেন, একসময় তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গোয়ালে গরু— সবই ছিল। এরপর ভাঙনের তীব্রতায় ভিটে থেকে শুরু করে সহায় সম্পদ সবই চলে গেছে যমুনার গ্রাসে। কেউ ওয়াপদার ঢালে, কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন। তারাই সবাই মিলে জীবিকা নির্বহের জন্য ঝুরি পিঠা তৈরিতে বেছে নিয়েছেন।
যমুনায় সব হারানো তেমন একজন জহুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নদীতে বাড়িঘর ভেঙে গেছে। বাঁধের ওপর বাড়ি করেছি। এখন বাঁধের ওপর থেকেও উচ্ছেদ করে দিয়েছে। আমরা অন্যের জমি ভাড়া করে ঝুরি তৈরি করে কোনোমতে জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছি।’
ঝুরি তৈরির কারিগর আব্দুল মালেক বলেন, এক বস্তা আটার ঝুরি তৈরি করতে খরচ চার হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৪২০০ থেকে ৪৩০০ টাকায়। আকাশের অবস্থা খারাপ হলে ঝুরি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে একসময় পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছিলেন এই গ্রামের কয়েকটি পরিবার। পরে ঝুরি পিঠা তৈরির সুযোগ পেয়ে আয়ের পথ পান তারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন আয়মনা বেগম (৫০), আলেয়া বেগম (৪৮), সুফিয়া খাতুন। তারা জানান, কেজি প্রতি ঝুরি বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। কেজিতে তাদের ১৫ থেকে ২৫ টাকা লাভ হচ্ছে। তাদের তৈরি ঝুরির চাহিদা থাকায় বিক্রিতেও বেগ পোহাতেও হচ্ছে না। বাড়ি থেকেই পাইকাররা এগুলো কিনে নিয়ে যায়।
পাইকারি ঝুরি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় আট বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুরি পাইকারি দরে কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসা-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা উৎসবসহ গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুরি পিঠার ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝুরি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।’
ঝুরি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে আতপ চালের গুঁড়া সরবরাহের জন্য হাট পাঁচিল গ্রামে চারটি চালকল গড়ে উঠেছে। তার একটির মালিক আব্দুল আলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঝুরি তৈরিকে কেন্দ্র করিই এখানকার চারটি চালকল চলছে। যারা ঝুরি তৈরি করে তারা এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকে। অনেককে বাকিতেও দেওয়া হয়। পরে ঝুরি বিক্রি করে তারা টাকা পরিশোধ করে থাকে।’
ঝুরিকে জীবিকা করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তার দাবি জানালেন কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘এ গ্রামের নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই ঝুরি তৈরির কাজ করেন। নিজে নিজে অনেক কষ্ট করে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন তারা। ঝুরি তৈরির প্রয়োজনীয় পুঁজি সহায়তা পেলে এ পেশায় তারা আরও ভালো করতে পারবেন।’
শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাটপাচিলে ভাঙন কবলিত মানুষগুলোর ঝুরি পিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি শুনেছি। তবে তারা কেউ আমাদের কাছে আসেনি। যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব।’
সারাবাংলা/টিআর
ঝুরি পিঠা ঝুরি পিঠায় জীবিকা যমুনার ভাঙন শাহজাদপুর উপজেলা সিরাজগঞ্জ হাটপঁচিল গ্রাম