ছাত্র-জনতার আন্দোলন
নিহত রফিকের পরিবারের আকুতি, চান শহিদের মর্যাদা
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৩৪
মানিকগঞ্জ: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মানিকগঞ্জের রফিকুল ইসলামের পরিবারের কান্না থামছে না। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক। কিন্তু পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনও ছিলেন তিনি। সেই ‘সোনার ছেলে’ হারিয়ে একদিকে শোকে কাতর মা-বাবা, অন্যদিকে উপার্জনের সহায় হারিয়ে পরিবার নিঃস্বও।
রফিকের প্রাণহানির ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করছে তার পরিবার। ছেলেকে হারালেও অন্তত ছেলের জন্য শহিদের মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি তাদের।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কার দিয়ে শুরু করে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন সরকার পতনের এক দফায় চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে, তখন ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হন রফিকুল ইসলাম। তিনি জেলার শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ঘাটসংলগ্ন রূপসা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক রহিজ উদ্দিন ছেলে।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, রফিক শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। আগের কয়েক দিনের মতো ৫ আগস্ট সকালে আন্দোলনে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। বলে যান, আন্দোলন থেকে পিছু হটবেন না। প্রয়োজনে দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তত তিনি।
পরিবারকে বলে যাওয়া শেষ কথা রেখেই ছেড়েছেন রফিক। বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষায় স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে সত্যি সত্যিই নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে।
রফিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত রফিকের স্ত্রী শাবনুর ১৬ মাসের মেয়ে রুহিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। অবুঝ শিশু মায়ের কোলে কাঁদছে। কিন্তু স্ত্রী শাবনুর যেন অধিক শোকে পাথর। কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুও যেন শুকিয়ে গেছে।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা-বাবা পাগলপ্রায়। ছেলে হারানোর শোকে এখনো কেঁদেই চলেছেন তারা। সাড়ে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে এই পরিবারে কান্না আর আহাজারি থামছেই না।
রফিকের স্ত্রী শাবনুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারে একমাত্র একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল রফিক। সংসারের ভরণপোষণের পুরো দায়িত্বই তার ওপর ছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে বাঁচতে দিল না। অল্প বয়সে আমাকে স্বামীহারা করেছে। মেয়েকে করেছে বাবাহারা।’
‘দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল রফিক। সত্যি সত্যিই জীবন দিয়ে বাড়ি ফিরল,’— বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে আসে শাবনুরের কণ্ঠ। কথা বলতে পারেন না আর। অনেকক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলেনম, স্বামীর হত্যার বিচার চান তিনি। যারা তার স্বামীকে খুন করেছে, তাদের ফাঁসি চান।
রফিকের মা চায়না বেগমও ছেলেকে হারানোর পর এখন পর্যন্ত কান্না থামাতে পারেনি। ‘সোনার ছেলে’ হারিয়ে শোকে কাতর তিনি। সেই শোকের মধ্যেই দারিদ্র্য আর অনটন ঘিরে ধরেছে তাকে। পুত্রবধূ আর নাতনিকে নিয়ে কীভাবে দিন কাটাবেন, সে দুশ্চিন্তাও তার রাতগুলোকে নির্ঘুম করে তুলেছে।
চায়না বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রফিক ছিল একমাত্র ছেলে। আমার সোনার ছেলে। সবসময় চোখে ভাসে ছেলের মুখ। শুধু মনে হয়, কোথা থেকে যেন ছেলে মা বলে ডাকছে। সেই ছেলে নেই, এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না। এক মুহূর্তের জন্যও ছেলেকে ভুলতে পারি না। ছেলে নেই, এ কথা ভাবলেই বুকটা কষ্টে ফেটে যায়।’
ছেলেকে হারানোর জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে দায়ী করছেন রফিকের মা। রফিকের মতো আরও হাজারও মানুষের হত্যার জন্যও তাকেই দায়ী মনে করেন তিনি। চাওয়া, এই গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনার যেন উপযুক্ত সাজা হয়।
মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও ছেলে রফিককে বাস্তবে ফিরে পাওয়া সম্ভব না, সেটিও বোঝেন চায়না বেগম। দেশের জন্য যে ছেলে প্রাণ দিয়েছে, তার জন্য তাই মায়ের চাওয়া মর্যাদা। চায়না বেগম বলেন, ‘ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। সরকারের কাছে অনুরোধ, ছেলের স্মৃতি রক্ষায় স্কুল-কলেজ কিংবা কোনো স্থাপনা তার নামে নামকরণ করা হোক। তাহলে হয়তো একটু শান্তি পাব। আর রফিকের জন্য শহিদের মর্যাদা চাই। এটুকুই।’
রফিকের বাবা কৃষক রহিজ উদ্দিনের কণ্ঠও বারবার বুঁজে আসছিল। মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। তবু বললেন, ‘‘একটি মাত্র ছেলে আমার। বাবা হয়ে ছেলের লাশ বহন যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার, কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। এই কষ্টের বোঝা আমাকে আজীবন বহন করতে হবে। আমি এক হতভাগা বাবা। যারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি না দেখিয়ে আল্লাহ যেন আমাকে মৃত্যু না দেয়।’
স্বজন ও বন্ধুদের দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন রফিকের পারিবারের পাশে দাঁড়ায়। জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠিত হয়েছে ছাত্র-আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য। তারা যেন রফিকের পরিবারকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়ে অর্থনৈতিকভাবেও পাশে দাঁড়ায়।
সারাবাংলা/এসআর/টিআর
ছাত্র-জনতার আন্দোলন মানিকগঞ্জ শহিদ রফিকুল ইসলাম শহিদের মর্যাদা শিবালয় উপজেলা