ফায়ার ফাইটার নয়নের বাড়িতে শোকের মাতম
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:৩১ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৪৯
রংপুর: প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারানো ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নের (২৪) বাড়িতে বইছে শোকের মাতম। একমাত্র ছেলেকে হারানোর খবর পাওয়ার পর থেকে কান্না থামেনি মা নার্গিস বেগমের। বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছেন তিনি। সন্তান বিয়োগের ব্যথা সইতে না পেরে বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন কৃষক বাবা আখতারুজ্জামান।
বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) দিনভর এমন চিত্রই দেখা যায় রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপড়িয়া গ্রামে সোয়ানুরের বাড়িতে। পরিবারের সদস্যরা কেবল নয়, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও সেখানে ছুটে এসেছেন। তাদেরও সবার চোখেই জল সোয়ানুরের জন্য। স্বজনদের আর্তনাদে ভারী আটপড়িয়া গ্রামের বাতাস।
স্বজনরা জানান, দুই ভাইবোনের মধ্যে সোয়ানুর ছিলেন ছোট। বছর দুয়েক আগে যোগ দিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসে। মূল কর্মস্থল ছিল সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। ডেপুটেশনে ছিলেন ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে। ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ টিমের সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রতিবেশীরা জানান, পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন সোয়ানুর। তার লক্ষ্য ছিল দ্রুত পদোন্নতি। তাই চাকরিরত অবস্থায় ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মাকে বলেছিলেন, ডিগ্রি পাস করতে পারলে পদোন্নতি হবে। অভাব কাটবে সংসারের।
আরও পড়ুন-
- নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নকে নিয়ে প্রেস সচিবের স্ট্যাটাস
- সচিবালয়ে আগুন নিভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহত
- বাড়িতে যাওয়ার ছুটি চিরদিনের ছুটি হলো ফায়ার ফাইটার সোয়ানুরের
- ফায়ার ফাইটারের মৃত্যুতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার, বিচারের আশ্বাস স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
সংসারের অভাব দূর করা তো পরের কথা, ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফলটা পর্যন্ত দেখে যেতে পারলেন না সোয়ানুর জামান নয়ন। যে আগুন সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের চারটি তলা পুড়িয়ে দিয়েছে, ওই আগুন নেভানোর সময় কাজ করতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। সন্তানের সেই কথা মনে করে কেবলই কান্না করছেন মা।
নার্গিস বেগম বলেন, “নয়ন ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিল। এখনো রেজাল্ট হয়নি। আমাকে বলত, ‘মা, আমি ডিগ্রি পাস করলে আমার পদোন্নতি হবে। তখন সংসারে অভাব থাকবে না।’ কিন্তু আল্লাহর কি লীলা, পরীক্ষার রেজাল্টটা পর্যন্ত আমার ছেলে জানতে পারল না।”
সোয়ানুরের বড় বোন সীমা আকতার জানালেন, ছেলের মৃত্যুতে বাবা আখতারুজ্জামান ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। মোবাইলে যখনই এ খবর পান, তখন থেকেই তিনি নির্বাক। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।
সোয়ানুরের মৃত্যুতে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেল উল্লেখ করে বোন সীমা আকতার বলেন, ‘ও আমাদের পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী ছিল। ওর বেতনের টাকাতেই আমাদের সংসার চলত। জানি না এখন কী করে সংসার চলবে।’
এর আগে বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে সচিবালয়ে আগুন লাগে। ওই সময় প্রথম টিম হিসেবে ঘটনাস্থলে যায় তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন। সেই টিমেই ছিলেন সোয়ানুর জাহান নয়ন। রাস্তায় পানির পাইপ নিয়ে কাজ করার সময় দ্রুতগতির একটি ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়।
গুরুতর আহত অবস্থায় সোয়ানুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ভোর পৌনে ৪টার দিকে চিকিৎসাধীন সোয়ানুরকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতর প্রাঙ্গণে সোয়ানুরের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ সময় অগ্নিসেনাদের একটি চৌকস দল তার মরদেহে গার্ড অব অনার দেয়। পরে সেখানে সোয়ানুরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় অংশগ্রহণ শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, সোয়ানুরের মৃত্যুতে ফায়ার সার্ভিস দক্ষ একজন কর্মীকে হারিয়েছে। তার পরিবার যেন ভালো থাকে, আমরা সে বিষয়টি অবশ্যই দেখব। পাশাপাশি তাকে চাপা দেওয়া ট্রাক জব্দ ও চালককে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনার বিচার করা হবে।
সারাবাংলা/এইচআই/টিআর