জুলাই বিপ্লবে নিহত মিনারুল, দুর্ঘটনার মৃত্যুসনদ দেন কাউন্সিলর!
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৪২ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:০১
রাজশাহী: নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন মিনারুল ইসলাম (২৭)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালীন ২০ জুলাই তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার মরদেহ রাজশাহীতে নিয়ে আসা হলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের চাপে গোরস্থানে দাফন করা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বলে। তবে এখন পরিবারের দাবি, মিনারুলের মরদেহ ময়নাতদন্ত করলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে যে, তিনি কীভাবে মারা গেছেন।
মিনারুল ইসলামের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর গুড়িপাড়া এলাকায়। ২১ জুলাই তার মরদেহ রাজশাহীতে নিয়ে আসা হয়। তখন ছুটে আসেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী। তিনি পরিবারকে বলেন, ‘মিনারুল গুলিতে নিহত হয়েছেন তা বলা যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলে লাশ দাফন করতে হবে।’
প্রতাপশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার মুখের ওপর তখন কোন কথা বলতে পারেননি নিহত মিনারুলের ভাই নাজমুল হক। সড়ক দুর্ঘটনা বলেই মৃত্যু সনদ করে দেন তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী। রাজশাহীতে এভাবেই জুলাই বিপ্লবের এক শহিদের মৃত্যুসনদে লেখা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
মিনারুল হকের ভাই সোহেল জানান, ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কম দেখাতে কাউন্সিলর রজব আলী ও তার ভাই যুবলীগ নেতা নাহিদ আক্তার নাহান তাদের বলতেই দেননি যে, মিনারুল মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। নানামুখী চাপে রেখেছিলেন তারা। আওয়ামী সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান নাহান। আর ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে গিয়ে বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন কাউন্সিলর রজব আলী।
এরপর, গত ৩ সেপ্টেম্বর নিহত মিনারুলের ভাই নাজমুল হক বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামিম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার, নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ১৩০ জনকে আসামি করা হয়।
রাজশাহীর কাউন্সিলর রজব আলী, তার ভাই নাহিদ আক্তার নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয় যেসব নেতাকর্মী পরিবারটিকে চাপে রেখেছিলেন, তাদেরও আসামি করা হয় এ মামলায়। এখন মামলার রাজশাহীর আসামিরা মিনারুলের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আলআমিন নগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুলের পেটের নিচে গুলি লাগে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে শহরের খানপুরে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন।
গত ২২ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘নারায়ণগঞ্জে দু’দিনে নিহত ১৩’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে আন্দোলনে নিহত হিসেবে মিনারুলের নাম আসে। ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি রাজধানীর হাতিরপুলে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘পোশাক খাতের চলমান পরিস্থিতি ও করণীয় এবং গণঅভ্যুত্থানে নিহত পোশাক শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ’ শিরোনামে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের ১৪ জনের নাম প্রকাশ করা হয়, এদের একজন মিনারুল।
নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক ২৬ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে। ওই সময় পর্যন্ত নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের ২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকার ৩৫ নম্বরে লেখা আছে, ‘মিনারুল ইসলাম, পিতা- মৃত এনামুল। গুডীপাড়ি, রাজশাহী।’
তবে নিহত মিনারুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের দৃষ্টি এড়ায়নি। একজন শহিদ হিসেবেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাকে। সম্প্রতি তার পরিবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছে। তবে এ নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি টেলিভিশনে মিনারুলের মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।
সংবাদ দুটিতে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মিনারুলকে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে টাকা তুলে নিয়েছে পরিবার। ওই সংবাদে মামলার আসামি সাবেক কাউন্সিলর রজব আলীর করে দেওয়া মৃত্যু সনদের ওপরেই জোর দেওয়া হয়, যেখানে মিনারুলের মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই রিপোর্ট শেয়ার করছেন। তবে পরিবার এবং এলাকাবাসীর প্রত্যেকেই বলছেন, মিনারুলের মৃত্যু হয়েছিল গুলিতে।
রাজশাহী নগরের গুড়িপাড়া পুরাপাড়া মহল্লায় বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মিনারুলের মা ডলি বেগম ও তার রিকশাচালক দুই ভাই নাজমুল হক এবং সোহেলের সঙ্গে। আন্দোলনে নিহত মিনারুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে প্রচার হলে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। একজন শহিদকে নিয়ে এমন অপপ্রচারে ভীষণ কষ্টও পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। বাড়ির সামনে দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা, ‘শহিদ মিনারুল’। প্রতিবেশী কয়েকজন শিশু এগিয়ে এসে বলল, ‘এটা আমরাই লিখেছি।’
মিনারুলের মা ডলি জানান, প্রায় একযুগ ধরে মিনারুল নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ২০ জুলাই মিনারুলসহ তিন জন বাজার করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। তার পর আন্দোলনের মাঝে পড়ে মিনারুলের তলপেটে গুলি লাগে। তার সঙ্গে থাকা সহকর্মীরা ফোন করে বিষয়টি জানান। কিন্তু মরদেহ আনার পর তৎকালীন কাউন্সিলর রজব আলী এ কথা প্রচার করতে দেননি। তারা সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করেন। শুধু তাই নয়, কাউন্সিলর রজব তার কার্যালয় থেকে মৃত্যু সনদও দেন সড়ক দুর্ঘটনা বলে।
মিনারুলের মরদেহ গোসল করিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা হলে তো শরীরের অন্য কোনো স্থানেও আঘাতের চিহ্ন দেখা যাবে। কিন্তু কোথাও কোনো আঘাত আমি দেখিনি। গোসলের সময় লাশ আমি উল্টে-পাল্টেই দেখেছি। শুধু তলপেটেই একটা গভীর ক্ষত ছিল। সেটা বুলেট ঢুকে যাওয়ার ক্ষত বলেই আমি মনে করি।’
মিনারুলের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জে তার মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কাউন্সিলর রজব আলী মরদেহ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দ্রুত মরদেহ ময়নাতদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ময়নাতদন্ত করলেই মৃত্যুর সঠিক কারণ সামনে আসবে।
এদিকে একজন শহিদের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করায় বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জি কে এম মেশকাত চৌধুরী মিশু। তিনি বলেন, ‘আমরা জুলাই ফাউন্ডেশন ক্রস চেক করে টাকা দিয়েছি। অনেকে এখনো টাকা পায়নি, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কেউ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই মিনারুল ইসলামের পরিবারের পাশে দাঁড়াব। কারণ, যে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, তাদের এজেন্ট এখনো রয়ে গেছে। তারা আমাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। যারা এসব অপপ্রচার করছে, তারা নিশ্চয় কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।’
রজব আলী গ্রেফতার হওয়ায় তিনি কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় মিনারুলের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে মৃত্যু সনদ দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আত্মগোপনে থাকা তার ভাই নাহিদ আক্তার নাহানের মুঠোফোন বন্ধ। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমরা মামলাটা তদন্ত করছি। সময় লাগলে লাগুক, তদন্ত সঠিক হবে। যেটা সঠিক, সেটাই বেরিয়ে আসবে।’
সারাবাংলা/পিটিএম