প্রশাসনে অস্থিরতা, সংকট কাটিয়ে গতি ফেরানোর চ্যালেঞ্জ
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:১০
ঢাকা: পদোন্নতি, পদায়ন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে গত সাড়ে চার মাস ধরে প্রশাসনে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ক্যাডারে-ক্যাডারে দ্বন্দ্ব। পদোন্নতিতে কোটা কমানো হতে পারে এই শঙ্কা থেকে ক্ষুদ্ধ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে সায় দিয়ে যুক্ত হয়েছেন প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তারাও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের পদত্যাগও দাবি করেছেন তারা।
এদিকে, পালটা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্য ২৫ ক্যাডার নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এর বাইরে বদলি, ওএসডি, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আতঙ্ক তো রয়েছেই। এই পরিস্থিতিতে দাফতরিক কাজে নেমে এসেছে ধীরগতি। রুটিন কাজ ছাড়া বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে পারছে না প্রশাসন। এই সংকট কাটিয়ে নতুন বছরে প্রশাসনে গতি ফেরানো সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেছেন নীতি নির্ধারকরা।
প্রশাসনে অস্থিরতা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই হিসাবে সরকার এরই মধ্যে পার করেছে সাড়ে চার মাস। নতুন সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া ১১ কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রশাসনে রদবদল। সেই রদবদলে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক অবসরে, আবার কিছু কর্মকর্তাকে করা হয় ওএসডি। অনেককে বদলি করে অন্যত্র পাঠানো হয়। হত্যা মামলাও হয় সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে গ্রেফতার হন ১২ জন। যা প্রশাসনে নজির সৃষ্টি করেছে।
প্রশাসনের এই রদবদলে পদোন্নতি, পদায়নের সংখ্যাও কম নয়। জনপ্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাড়ে চার মাসে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে সচিব করা হয়েছে ২৩ কর্মকর্তাকে। গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৭ জন। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৪ জন। এ নিয়েও প্রশাসনের একাংশের মধ্য চলছে শীতল ক্ষোভ। আবার একাংশ বিক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
যুগ্মসচিব পর্যায়ের ওইসকল কর্মকর্তাদের বক্তব্য, বর্তমান সরকার যাদের পদায়ন, পদোন্নতি দিয়েছে তাদের মধ্যেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তরাও রয়েছেন। যাদের কারণে তারা বিগত সময়ে বঞ্চিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুগ্মসচিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নানাদিক থেকে যাদের মাধ্যমে বঞ্চনার শিকার হয়েছি গতকয়েক বছর, সেই কর্মকর্তাদেরই এখন পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, পদায়ন করা হচ্ছে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল।’
এই পরিস্থিতির মধ্যেই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বৈষম্য মেটাতে বিভিন্ন দাবি নিয়ে সোচ্চার অন্য ২৫ ক্যাডার নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। পাশাপাশি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক সুপারিশকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত প্রশাসন ক্যাডারও।
মুখোমুখি প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডার
ক্ষোভের সূত্রপাত গত ১৭ ডিসেম্বর, গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে। সেখানে কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, উপসচিব পদে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতি হবে ৫০/৫০ অনুপাতে। আর সেখানে পদোন্নতি নিতে হবে পরীক্ষা দিয়ে। একই সভায় কমিশনের সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান জানিয়েছিলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার আলাদা করার সুপারিশ করবে কমিশন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান ও সদস্যের এই বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নেননি প্রশাসনের কোনো ক্যাডারই। কারণ ৫০/৫০ অনুপাত চায় না প্রশাসন ক্যাডার। আবার আলাদা হতে চান না শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানানো হয়েছে। একই ঘটনা দেখা গেছে, বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস হেলথ ক্যাডার এসোসিয়েশনের বিবৃতিতে। যদিও তাদের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে ২৫ ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।
এ প্রসঙ্গে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’র অন্যতম সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে কোটাকে কেন্দ্র করে এত বড় আন্দোলন হলো, সরকার পতন হলো, সরকার কোটা তুলে দিলো। তারপরেও কোটার বিষয় কেন থাকবে?’ তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেখানে সব ক্যাডার থেকে প্রতিনিধি রাখার কথা থাকলেও প্রশাসন ক্যাডার থেকেই ছয় সদস্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের বাইরে থাকা বাকি ২৫ ক্যাডার থেকে কিন্তু কোনো প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলছি, ৫০/৫০ শতাংশ অনুপাতে কেন, এখানে (উপসচিব) কোনো শতাংশই থাকার কথা না। আমাদের দাবি ক্যাডারভিত্তিক সমতা, বিভাগভিত্তিক গ্রেড-১ এবং ক্যাডারভিত্তিক মন্ত্রণালয়।’
বর্তমানে প্রশাসন থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ আর অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। বর্তমানে উপসচিবের সংখ্যা ১৬০০। বর্তমানের এই বিধান বিলুপ্ত করার দাবি প্রশাসনের বাইরে থাকা ২৫ ক্যাডারের। আর প্রশাসন ক্যাডার চায়, বিধান বর্তমানে যেটা আছে সেটিই বহাল থাকুক। এরমধ্যে দুই ক্যাডার থেকে সমান সমান অনুপাতে উপসচিব পদোন্নতির যে বিষয়টি সংস্কার কমিশন সামনে এনেছে মূলত এর পর থেকেই ক্ষুদ্ধ প্রশাসন ক্যাডার।
গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সমাবেশে সংস্কার কমিশন প্রধানের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। একইসঙ্গে কমিশন যদি কোনো অযাচিত দাবি করে তাহলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এ বি এম আব্দুস সাত্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি কমিশন কী সুপারিশ দেয়। যদি অযাচিত কোনো সুপারিশ করে তাহলে বড় কর্মসূচি দেবো।’
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিশন এখনো কাজ করছে। এখন পর্যন্ত এসব বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। সুপারিশ করার আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করা হবে।’
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও সচিবহীন মন্ত্রণালয়
অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সরকারের পদোন্নতি নিয়েও। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেওয়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। বলা হয় এ সরকার এমন নিয়োগ দেবে না। কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। ১০ এমনকি ২০ বছর আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদেরও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ও অবসরে যাওয়া ৭৬৪ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত কমিটি। এদের মধ্যে অনেককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রশাসনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে, প্রশাসনের এই তালগোলে পরিস্থিতিতে সচিবহীন চার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে গত অক্টোবরে ওএসডি করা হয়। তার এক মাস পর নভেম্বরে ওএসডি করা হয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব শাহানারা খাতুনকে। এখন পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের দু’টি বিভাগের কোনোটিতেই সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সচিব নেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সেতু বিভাগেও। একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদ। যার তদারকিতে ওই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাজ তরান্বিত হয়, গতিতে থাকে। গত কয়েক মাস এইসব মন্ত্রণালয়ে সচিব না থাকায় কাজে ধীরগতি নেমে আসছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে প্রশাসনের এই পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খলা বলতে চান না কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে। আর নতুন বছরে এটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘১৫ বছর প্রশাসনে যে দুঃশাসন চলেছে, সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে সুসংগঠিত হতে তো সময় লাগবে।’ বিষয়গুলো একে একে সমাধান হয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম
অস্থিরতা উপসচিব ক্যাডার গতি চ্যালেঞ্জ প্রশাসন যুগ্মসচিব সংকট সচিব সরকার