ঢাবির নিয়োগ বোর্ডে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১৪ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:২৩
ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন জায়গাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় রয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু ঢাবির বিভিন্ন নিয়োগ বোর্ডে এখনো আওয়ামীপন্থী নীল দলের শিক্ষকরা বহাল রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো নিয়োগ বোর্ডে পরিবর্তন আনেনি।
এদিকে পুনর্গঠন না করেই গত ১৩ নভেম্বর থেকে ঢাবির সিলেকশন বোর্ডগুলো কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের পদোন্নতিসংক্রান্ত একটি বোর্ডও বসেছে। এ ছাড়া, সম্প্রতি পালি ও বুদ্দিস্ট বিভাগেও একটা প্রমোশন বোর্ড বসে। যেখানে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে একজন করে শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ঢাবির নিয়োগ বোর্ডের তথ্য থেকে জানা গেছে, কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আব্দুল বাছির বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, ইসলামিক ইতিহাস ও আরবিসহ এখনো অন্তত ১৬টি নিয়োগ বোর্ডে বহাল আছেন। কলা অনুষদের সব নিয়োগ বোর্ডে ডিন হিসেবে এখনো তার নাম পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া, পাবলিক হেলথ, মনোবিজ্ঞান, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসহ ঢাবির সাতটি নিয়োগ বোর্ডে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়ার নাম রয়েছে। ঢাবির বাইরেও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডে আছেন তিনি। এমনকি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও জালিয়াতির কারণে ঢাবির তিন শিক্ষককে দুদক ডেকেছেন বলে জানা গেছে। যার মধ্যে নিজামুল হক ভূঁইয়ারসহ খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের আরও দুই শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
এর বাইরে ঢাবির হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান এখনো ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগসহ অন্তত পাঁচটি নিয়োগ বোর্ডে আছেন তিনি।
ঢাবির সাবেক উপ-উপাচার্য আব্দুস সামাদ এখনো অন্তত ১৫টি নিয়োগ বোর্ডে বহাল আছেন। সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) সীতেষ চন্দ্র বাছারের নামও রয়েছে ঢাবির সকল নিয়োগ বোর্ডে। এছাড়া, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিন্নাত হুদা এখনো সামাজিক বিজ্ঞান, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজসহ অন্তত চারটি নিয়োগ বোর্ডে বহাল আছেন।
অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এখনো ঢাবির বিজনেস অনুষদের তিনটি নিয়োগ বোর্ডে রয়েছেন। যিনি পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের গবেষণা সুপারভাইজার ছিলেন। যে গবেষণার ৯৮ শতাংশেই জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শিক্ষককে জোর করে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া ও ক্লাসে ফাঁকি দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
শুধু এই শিক্ষকরাই নন, ঢাবির প্রতিটি নিয়োগ বোর্ড আগের মতো রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে চায়। আওয়ামীপন্থী এক শিক্ষককে ঢাবির সিন্ডিকেট মেম্বার বানানো হলো। একজনকে হলের প্রভোস্ট বানানো হলো। এমনকি যারা আওয়ামী লীগের ১৫ বছর সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে তারা এখনো স্ব-স্ব অবস্থানে বহাল তবিয়তে আছেন। তাহলে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের তাৎপর্য কী রইল?’
এ নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থী রিফাত আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বর্তমান ভিসি তেমন কিছুই করতে পারেনি। বিভিন্ন সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তার উচিত আওয়ামী দোসরসহ অন্যান্য যেসকল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নূমান আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন প্রশাসন নিয়োগ পাওয়ার প্রায় চার মাস হয়ে গেলেও বিভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড থেকে আওয়ামী দোসরদের সরাতে না পারা সুস্পষ্ট ব্যর্থতা। হয়তো এই জায়গায় তাদের অনীহা রয়েছে। এই অনীহার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না তা খুঁজে বের করা উচিত।’
ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত শিক্ষকদের কোনো পদে রাখা উচিত না। সেসকল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, মামলা ও নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল আমরা তাদের নিয়োগ বোর্ডে দেখতে চাই না।’
নিয়োগ বোর্ডগুলো কেন পুনর্গঠন হচ্ছে না? জানতে চাইলে ঢাবি রেজিস্ট্রার মুন্সী শামসুউদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডগুলো আগে করা হয়েছে। তাই, এখনো ভাঙা হয়নি। বর্তমান প্রশাসন এখন এসব বিষয়ে ভাবছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
নিয়োগ বোর্ড পুনর্গঠনের বিষয়ে জানতে ঢাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। তবে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। অনেকগুলো নিয়োগ বোর্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাঙতে হবে। অনেকগুলো আবার রাষ্ট্রপতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভাঙতে হবে। এটা আসলে সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা চেষ্টা করছি।’
সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম