ফিরে দেখা ২০২৪
হতাশার অন্ধকার থেকে আলোর ঝরনাধারায় বিএনপি
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:০১ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:২৯
ঢাকা: ২০১১ সালের ৩১ জুন রাষ্ট্রীয় সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর ওই বছর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে রাজপথে কঠোর আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এই আন্দোলন যত তীব্র হয়েছে, তত কঠিন হয়েছে ক্ষমতাসীনদের প্রতিরোধ। রাজপথে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে বিএনপির ওপর নিপিড়ীন-নির্যাতনও বেড়েছে সমানুপাতিক হারে। ফলে বারবার হারতে হয়েছে বিএনপিকে। হারতে হারতে যেন জেতার কথা ভুলেই গিয়েছিল দলটি।
এই সুযোগে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিন তিনটি ‘একতরফা’ নির্বাচন করে ফেলে ক্ষমতাসনী আওয়ামী লীগ, যার শেষটি ছিল বিদায়ী বছরের ৭ জানুয়ারি। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। আর হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপির বেশির ভাগ নেতা চলে যান আত্মগোপনে। বাকিদের জায়গা হয় কারাগারে। তৃণমূল নেতারা হন ঘরছাড়া। বনে-জঙ্গলে কাটে কারও কারও জীবন।
এভাবে শুরু হওয়া বছরটাতে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। দৈব বা ভাগ্যের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না দলটির সামনে। টিকে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে সাময়িক বিরতিতে ছিল তারা। এ কারণে ফেব্রুয়ারির পর রাজপথে বড় কোনো কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি। ছোট ছোট কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠন গোছানো এবং কারাবন্দি নেতাদের মুক্তিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছিল দলটি।
এদিকে মারাত্মক অসুস্থ খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হচ্ছিল। বরাবরের মতোই তা অগ্রাহ্য করে আসছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন খালেদা জিয়া। ফলে হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকরা স্বপ্ন দেখতেও যেন ভুলে গিয়েছিলেন। আলোর সন্ধানে ফিরছলেন তারা।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন হঠাৎ করেই জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ছাত্রদের ব্যানারে মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিএনপি। আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে দলটি।
অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ৬ আগস্ট থেকেই রাজনীতির চেহারা পালটে যায়। রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রতিদিন কারাগার থেকে মুক্তি পেতে থাকেন নেতাকর্মীরা। ঢাকাসহ সারা দেশে বিশাল জমায়েতে বাধাহীন সমাবেশ করে দলটি। প্রায় সব সমাবেশে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার বক্তব্য প্রচারের ওপর থেকে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
নানামুখী কর্মকাণ্ডে চাঙ্গা হয়ে ওঠে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। মহানগর, জেলা-উপজেলা ও থানায় নতুন কমিটি দেয় দলটি। সরকারে না থাকলেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে বিএনপি সমর্থিত কর্মকর্তারা সামনে চলে আসেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিএনপিপন্থিরা সরব হয়ে ওঠে।
বিদায়ী বছরে বিএনপির আলোচিত পাঁচ
-
খালেদা জিয়ার মুক্তি
২০২৪ সালে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা বন্দিদশা থেকে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পেলেও সরকার পতনের এক দিন পর সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান তিনি। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করেন। মুক্তির পরপর নয়াপল্টনের সমাবেশে অনলাইনে বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনায় উপস্থিত হন তিনি।
-
মামলা থেকে খালাস তারেক রহমান
গত ১৮ বছরে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট ৮৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে পাঁচটিতে সাজা হয় তার। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত তিনি খারিজ, খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছেন ৩৯টি মামলায়। এর মধ্যে সবচেয় আলোচিত ছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা। এ মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। বিদায়ী বছরের ১ ডিসেম্বর আলোচিত এই গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে দেওয়া এই রায়ে তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পান। এরই মধ্যে কারামুক্ত হয়েছেন এ মামলার অন্যতম আসামি মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু।
-
একের পর এক কারামুক্ত শীর্ষ নেতারা
গত বছর ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। ওই দিন পুলিশ হত্যা, বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে একে একে সবাই বেরিয়ে এসেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবীব উন নবী খান সোহেলসহ শত শত কেন্দ্রীয় নেতা এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয় আগে থেকে কারাগারে থাকা বেশ কয়েকজন নেতা আদালতের মাধ্যমে খালাস পেয়ে কারামুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— তারেক রহমানের বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দীন মামুন, তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী মিয়া নুরুদ্দিন অপু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
-
দেশে ফিরছেন প্রবাসে থাকা নেতারা
হামলার-মামলার শিকার হয়ে এবং বিভিন্ন মামলায় সাজা নিয়ে দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা একে একে দেশে ফিরছেন। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন শীর্ষ নেতা দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন ফালু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল মালেক উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মধ্যম সারির কয়েক ডজন নেতাও দীর্ঘকাল পর দেশে ফিরেছেন।
-
কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেকেই
‘কঠিন পরিস্থিতি’র মধ্যে দল ছেড়ে না যাওয়া, ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে রাজপথে পড়ে থাকা এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকায় অনেক নেতাকেই মূল্যায়ন করেছে বিএনপি। ভাইস চেয়ারম্যান থেকে পদোন্নতি পেয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিশেষ সম্পাদক থেকে ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন ড. আসাদুজ্জামান রিপন, প্রচার সম্পাদক থেকে যুগ্ম মহাসচিব হয়েছে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন আবদুস সালাম আজাদ, যুবদলের সভাপতি থেকে মূল দলের প্রচার সম্পাদক হয়েছেন সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব থেকে আহ্বায়ক হয়েছেন আমিনুল হক।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাত্র-জনতার আন্দোলন ফিরে দেখা ২০২৪ বিএনপি সালতামামি