কনটেইনার-কার্গো হ্যান্ডলিং: আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:১১ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:০৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, আমদানিতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা, ডলার সংকটের ধাক্কার মধ্যেও কনটেইনার ও কার্গো (পণ্য) হ্যান্ডলিংয়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বিদায়ী ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ টিইইউস। আর কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন।
বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছরের মতো কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড অতীতে চট্টগ্রাম বন্দরের নেই। প্রবাসী আয়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বছরের শেষ দিকে আমদানি-রফতানিও বেড়েছে। এতেই রেকর্ড গড়ে দেশের অর্থনীতির সুখবর দিতে পেরেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে কিছু সময়ের জন্য অস্থিরতা বাদ দিলে বছরজুড়ে চট্টগ্রাম বন্দর অতীতের মতোই দক্ষতার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছে। নতুন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযোজনের ফলে আমাদের বন্দরের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর প্রভাব কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে পড়েছে। এটা শুধু বন্দরের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও সুখকর খবর।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, বছরের দু’দিন বাকি থাকতেই গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দরে ৩২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৮৬ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১২ কোটি ৩১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৩ মেট্রিক টন।
চলতি বছরের মে মাসে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ১৯৩ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে কম ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৬ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ২৯ দিনে হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ টিইইউএস।
বন্দরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬২ টিইইউস, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৬, মার্চে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৭৪, এপ্রিলে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৯, মে মাসে ৩ লাখ ১৯৩, জুনে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭৩, জুলাইয়ে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৫, আগস্টে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৯, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৪, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৯ এবং নভেম্বরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৮ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ও এর আওতাধীন কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও পানগাঁও নৌ টার্মিনালের দিয়ে আমদানি-রফতানি ও খালি মিলিয়ে কনটেইনার পরিবহন হয় ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউস। ২০২২ সালে ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫০৪, ২০২১ সালে ৩২ লাখ ১৪ হাজার কনটেইনার পরিবহন হয়।
এর আগে, ২০২০ সালে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭, ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭, ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ এবং ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ কনটেইনার পরিবহন করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।
এছাড়া ২০২৩ সালে ১২ কোটি ২ লাখ মেট্রিক টন কার্গো (পণ্য) পরিবহন হয়। ২০২২ সালে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮২ মেট্রিক টন ও ২০২১ সালে পরিবহন হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০১৯ সালে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা। বন্দরে জাহাজ আসার পরিমাণ কমেছে। চলতি ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ হাজার ৮২২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে।
এর আগে, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর জাহাজ হ্যান্ডলিং করে ৪ হাজার ১০৩টি। ২০২২ সালে ৪ হাজার ৩৬১টি, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৫৪টি, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৭২৮টি এবং ২০১৯ সালে ছিল ৩ হাজার ৮০৭টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়।
জাহাজ আসার পরিমাণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বন্দর সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কনটেইনার জাহাজ আসা কিছুটা কমেছে। এখন যেসব জাহাজ আসছে, সেগুলো আগের চেয়ে বড় জাহাজ। বন্দরে এখন সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে। আগে তো সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যেত। সে কারণে এখন আগে যদি এক হাজার কনটেইনার নিয়ে একটি জাহাজ আসতো, এখন তার চেয়ে বড়ো অর্থাৎ দেড়-দুই হাজার কিংবা আড়াই হাজার এমনকি ২৮০০ কনটেইনার নিয়েও জাহাজ আসছে। সুতরাং জাহাজ কম আসার কারণে আমদানি-রফতানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি।’
বন্দর কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের অর্থনীতিও নাজুক অবস্থায় ছিল। ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে গিয়েছিল। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। রফতানিতেও প্রভাব পড়েছিল।
এর মধ্যে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় বন্দরে কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং কিছুদিন প্রায় বন্ধ ছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর প্রবাসী আয় বেড়ে যায়। দেশের রিজার্ভও বাড়তে থাকে। এর ফলে বছরের শেষদিকে এসে আমদানি-রফতানি আবারও বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বন্দরে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে শুরু করে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘ডলার সংকট কেটে যাওয়ায় আমদানি বেড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কা কাটিয়ে রফতানিও বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে যে রেকর্ড গড়েছে, সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই সুখবর। আশা করছি প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকবে।’
দেশে আমদানি-রফতানিকেন্দ্রিক সমুদ্র বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার ও পণ্য পরিবহনের ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
সারাবাংলা/আরডি/আরএস