Friday 03 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফিরে দেখা ২০২৪
রেকর্ড তাপমাত্রা আর জলবায়ুর অভিঘাতে কোটি মানুষের সংগ্রামের বছর

হুজ্জাতুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০৮ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০১:২৪

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সারা বিশ্বকেই ব্যাপক ভুগতে হয়েছে ২০২৪ সালে, বাংলাদেশেও তাপপ্রবাহের নতুন রেকর্ড হয়েছে

২০২৪ সালে চরম আবহাওয়া বিপৎসীমাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ বছরের রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রা, লাগামহীন তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, ঝড় ও বন্যায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। চরম আবহাওয়ার কারণে জনজীবন এরইমধ্যেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু গবেষণা সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ঘটে যাওয়া মাত্র ২৬টি ঘটনা পর্যলোচনাতেই উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী অন্তত তিন হাজার ৭০০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষকে। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর তীব্র আবহাওয়াগত ঘটনায় নিহত মানুষের মোট সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।

বিজ্ঞাপন
  • তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে কোটি কোটি মানুষ

স্থল ও সমুদ্রের তাপমাত্রায় আগের একাধিক রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৪ সাল। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) জানিয়েছে, এ বছরটি পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে।

জার্মান আবহাওয়া কার্যালয় (ডিডব্লিউডি) গত ১৭ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৮৮১ সালের পর ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে জার্মানির সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এ বছরের তাপমাত্রা আগের, অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালের দুটি উষ্ণতম বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।

আজারবাইজানের বাকুতে হওয়া কপ-২৯ সম্মেলনে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ‘স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট’ নামক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সাল আবারও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। এ ক্ষেত্রে ২০২৪ সাল কেবল উষ্ণতম বছর নয়, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকও হবে ইতিহাসের উষ্ণতম। এই সময়ে হিমবাহ থেকে বরফ গলা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও উত্তাপ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে। আর এই চরম পরিবর্তিত আবহাওয়া বিশ্ব জুড়ে মানুষ ও দেশে অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করছে, যা বহু দেশে নিয়ে এসেছে অস্থিতিশীলতা।

বিজ্ঞাপন

শুধু জার্মানি নয়, ২০২৪ সাল বিশ্বেরই সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরাও। গত নভেম্বরে কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) জানিয়েছে, তাপমাত্রার রেকর্ড রাখতে শুরু করার পর থেকে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে যাচ্ছে ২০২৪ সাল। উষ্ণতায় এই বছরটি ২০২৩ সালকে যে পেছনে ফেলে দেবে, সে বিষয়ে ‘কার্যত নিশ্চিত’ তারা।

গত এপ্রিলে পশ্চিমে লেবানন থেকে পূর্বে কম্বোডিয়া পর্যন্ত কয়েক ডজন দেশ দীর্ঘায়িত তাপপ্রবাহের শিকার হয়েছিল। ওই সময় এসব দেশে পানিশূন্যতা ও তাপ স্ট্রোকের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টারের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জুলি আরিঘি বলেছেন, এই ঝুঁকি সবার জন্য সমানভাবে অনুভূত হয় না। সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, তারা শারীরবৃত্তীয়ভাবে প্রচণ্ড তাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম নন। তারা প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে ছিলেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। সেটি বিবেচনায় নিয়েও ২০২৪ সালে বিশ্বের সব মানুষকে অন্তত ৪১ দিন চরম বিপজ্জনক তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

  • অ্যামাজনে ভয়াবহ খরা

২০২৪ সালে জলবায়ুর সংকটে ভয়াবহ খরার কবলে পড়ে বিশ্বে কার্বনের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার অ্যামাজন রেইনফরেস্ট। অ্যামাজন অববাহিকার তিনটি দেশে ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও পেরুতে রেকর্ড খরা দেখা দেয় এ বছর। ফলে পানির অভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে চার লাখ ২০ হাজার শিশু।

গত বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া এই খরা এ বছর আরও তীব্র হয়েছে। এটি বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অত্যন্ত বাজে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের মতো আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো এই খরার মূল কারণ হিসেবে ২০২৩-২০২৪-এর এল নিনোকে চিহ্নিত করেছে। খরার কারণে অ্যামাজন রেইনফরেস্টের নদীগুলোর পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে গেছে, যা জীবিকার জন্য নির্ভরশীল কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এই খরা কেবল পানির সংকটই তৈরি করেনি, বরং খাদ্যা ও স্বাস্থ্যসেবারও সংকট তৈরি করেছে। ফলে শিশুদের পুষ্টিহীনতা ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।

ওই তীব্র খরার সময় ইউনিসেফ বলেছিল, এই সংকট মোকাবিলায় কয়েক মাসে তাদের অন্তত এক কোটি মার্কিন ডলারের জরুরি তহবিল প্রয়োজন, যেন এই অঞ্চলে পানির সরবরাহ ও স্বাস্থ্য সেবা চালু রাখা যায়। পাশাপাশি, বিশেষভাবে শিশুদের জন্য জলবায়ু অর্থায়ন বাড়ানোর জন্য বিশ্বনেতাদের কাছে দাবি জানিয়েছিল ইউনিসেফ।

  • ফিলিপাইনের একের পর এক টাইফুনের হামলা

অক্টোবর ও নভেম্বরে মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ছয়টি টাইফুন আঘাত হানে ফিলিপাইনে। উষ্ণ মহাসাগরের জলের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে দেশটি এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

এ মৌসুমে ঝড়ের কারণে সৃষ্ট ভূমিধস ও বন্যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে এক হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। গবেষকরা বলছেন, টাইফুন, হারিকেন বা ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকা রাখছে— এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এসব দুর্যোগের তীব্রতা বাড়াচ্ছে।

  • হারিকেনকে ত্বারান্বিত করেছে বাড়তি তাপমাত্রা

চলতি বছর ধনী দেশগুলোও চরম আবহাওয়ার প্রভাব থেকে নিজেদের পুরোপুরি রক্ষা করতে পারেনি। খ্রিষ্টান এইডের গবেষণা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুটি হারিকেন সংগঠিত হয়। এতে ২৬০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। এ ছাড়া এতে ১১ হাজার ৫০০ ডলার মূল্যের ক্ষতি হয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হারিকেনকে প্রভাবিত করেছে।

  • নাইজেরিয়া-সুদানে ভয়াবহ বন্যা

নাইজেরিয়ার মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় জুলাইয়ে। এতে অন্তত ৬০ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর (দেড় লাখ একর) জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ভয়াবহ বন্যায় পশ্চিম আফ্রিকার বৃহত্তম দেশেটিতে অন্তত ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

অন্যদিকে সুদান এ বছর বেশ কয়েকবার বন্যার কবলে পড়ে। এর মধ্যে সবশেষ নভেম্বরের ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে আগস্টের বন্যায় প্রাণ হারায় ৬০ জন।

ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদন বলছে, মানুবসৃষ্ট উষ্ণায়নের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত এসব বন্যার প্রধান কারণ।

  • বাংলাদেশেও রেকর্ড তাপপ্রবাহ, রেকর্ড তাপমাত্রা

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এ বছর তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহে নতুন রেকর্ড হয়েছে। এ বছরের ২৯ মার্চ থেকে শুরু করে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা ৩৩ দিন ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যায় দেশের ওপর দিয়ে। এর আগে কখনোই এক মৌসুমে এত বেশি দিন ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়নি। মে মাসের একদম প্রথমেই বৃষ্টি শুরু হলে শেষ পর্যন্ত ওই তাপপ্রবাহের অবসান ঘটে।

কেবল তাপপ্রবাহ নয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রারও এক রেকর্ড হয় এ বছর। গত ৩০ এপ্রিল পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আর এক দিনই এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১৮ মে। সেদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছিল। সে হিসাবে এ বছর দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং ৫২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়।

চলতি মৌসুমে এই তীব্র তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা ও রাজশাহীসহ দেশের উত্তর ও পশ্চিমের জেলাগুলোকে। দেশের বাকি এলাকাগুলোও নিস্তার পায়নি। ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে দফায় দফায়। বন্ধ করে দিতে হয়েছে স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাপপ্রবাহের শিকার হয়ে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।

[বিবিসি অবলম্বনে]

সারাবাংলা/এইচআই/টিআর

খরা জলবায়ু পরিবর্তন জলবায়ুর অভিঘাত টাইফুন তাপপ্রবাহ তাপমাত্রায় রেকর্ড তীব্র খরা তীব্র তাপপ্রবাহ বন্যা হারিকেন

বিজ্ঞাপন

উষ্ণতার জন্য | ছবি
৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪০

নতুন বইয়ের ঘ্রাণ
৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:১৫

আরো

সম্পর্কিত খবর