বছর জুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১০১২১৪, সুস্থতার হার ৯৮.৮%
১ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০৫ | আপডেট: ১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৮
ঢাকা: বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাছিল ডেঙ্গু। জুন-জুলাই থেকে বাড়তে থাকলেও সেপ্টেম্বর থেকে ডেঙ্গু সংক্রমণ চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর পর্যন্ত সংক্রমণের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে ৫৭৫ জন মারা গেছেন। আর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৪০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই হিসাব অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার হার ৯৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর বছরের শেষ দিনেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫৯৯ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ এখন প্রতিবছরই মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। তাই ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করলে হবে না, শুরু থেকেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর জন্য কাজ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বছর ধাপে ধাপে প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
বছর জুড়ে ডেঙ্গু সংক্রমণের চিত্র
২০২৩ সালের শেষের দিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর যে ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যায়, তার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতেও। বছরের শুরুর এই মাসে এক হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১৪ জনের।
ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই সংখ্যা কমে আসতে থাকে। এ মাসে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে দেশে ৩১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয় পাঁচজনের। এপ্রিলে ৫০৪ জন, মে মাসে ৬৪৪ জন ও জুনে ৭৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। এর মধ্যে এপ্রিলে দুজন, মে মাসে ১২ জন ও জুনে আটজনের মৃত্যু হয়।
জুলাই মাস থেকে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু রোগী। জুনের তুলনায় এ মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল প্রায় সাড়ে তিনগুণ। সব মিলিয়ে জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হন দুই হাজার ৬৬৯ জন। আগস্টে সে সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫২১ জনে। সেপ্টেম্বরে আরও প্রায় তিন গুণ বেড়ে রোগী হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ে ১২ জন, আগস্টে ২৭ জন ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৭ জনের মৃত্যু হয়।
এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ চূড়ান্ত আকার ধারণ করে অক্টোবরে। এ মাসে বছরের সর্বোচ্চ ৩০ হাজার ৮৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মাঝে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। নভেম্বরেও ডেঙ্গু সংক্রমণ ছিল কাছাকাছি— ২৯ হাজার ৬৫২ জন। তবে এ মাসে আবার বছরের সর্বোচ্চ ১৭৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে সংক্রমণ কিছুটা কমে এসেছে। এ মাসে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৭৪৫ জন। এ মাসে ৮৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ডেঙ্গুতে মৃত প্রতি ৯ জনের একজন শিশু
দেশে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৭৫ জনের। এর মধ্যে ৬৪ জনের বয়স ১৫ বছরের নিচে। অর্থাৎ চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ বা প্রতি ৯ জনের মধ্যে একজন ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
এর মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে পাঁচ হাজার ৬১৫ জন। এ বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল চার হাজার ৮৬১ জন, মৃত্যু ১৪ জনের। আর ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ১০৬ জন, মৃত্যু হয় ছয়জনের।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি পুরুষ, মৃত্যু বেশি নারীর
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের হারই বেশি। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের মধ্যে আবার নারীর হার বেশি।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৮৮৬ জন, বিপরীতে নারীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ৩২৮ জন। অর্থাৎ মোট ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৬৩ দশমিক এক শতাংশ পুরুষ, ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। সে হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর দেড় গুণেরও বেশি।
অন্যদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেশি হয়েছে নারীদের। সারা বছরের হিসাব বলছে, ডেঙ্গুতে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারী ২৯৪ জন, পুরুষ ২৮১ জন। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে যারা মারা গেছেন তাদের ৫১ দশমিক ১ শতাংশ নারী, ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণভাবে দেশে নারীদের অসুস্থতাকে হালকা করে দেখার যে প্রবণতা রয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হওয়ার কারণে নারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে।
রোগী বেশি ঢাকার হাসপাতালগুলোতে
দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মাঝে সর্বোচ্চ ২১ হাজার ২৫৪ জন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১৭ হাজার ৮৭৯ জন।
সে হিসাবে দুই সিটি করপোরেশনেই রোগী ভর্তি হয়েছে ৩৯ হাজার ১৩৩ জন, যা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর ৩৮ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতি প্রায় আড়াইজনের একজনই চিকিৎসা নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো একটি হাসপাতালে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্য হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে আরও ১৮ হাজার ৪৭১ জন। এই হিসাবে শুধু ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে ৫৭ হাজার ৬০৪ জন, যা মোট ডেঙ্গু রোগীর প্রায় ৫৭ শতাংশ।
ঢাকার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে। তাদের সংখ্যা ১৫ হাজার ৪০৬ জন। খুলনা বিভাগে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৯৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। বরিশাল বিভাগে এ সংখ্যা আট হাজার ৮০১ জন।
এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে তিন হাজার ৮৮৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে তিন হাজার ৩৬২ জন, রংপুর বিভাগে এক হাজার ৫০৯ জন ও সিলেট বিভাগে ৩৩৮ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকার ২ সিটিতেই মৃত্যু ৬০%
ডেঙ্গুতে মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন ২৩৯ জন, ঢাকা উত্তরে ১০৪ জন। দুই সিটি মিলিয়ে ৩৪৩ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে, যা মেট মৃত্যুর প্রায় ৬০ শতাংশ।
দুই সিটির বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য এলাকার হাসপাতালগুলোতে আরও ৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। সব মিলিয়ে ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন ৩৯৪ জন, যা ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ৬৮ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ সারা দেশে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে।
ঢাকার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে, তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৫ জন মারা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। চতুর্থ সর্বোচ্চ ৩৫ জন মারা গেছেন খুলনা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে আটজন ও রংপুর বিভাগে তিনজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন।
দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর জটিলতা
মুগদা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সত্যজিত কুমার সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকেই জ্বর আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই চিকিৎসা শুরু করে দেন। পরে অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ রকম দেরি করার জন্য রোগীর শারীরিক অবস্থা পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যায়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অনেকেই শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে দ্রুত।
একই কথা বললেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ কমিটি কাজ করছে। তবে আমাদের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে মৃত্যু বেশি হচ্ছে ডেঙ্গুতে। সঠিক সময়ে হাসপাতালে গেলে ও চিকিৎসা নিলে এই হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। আর সচেতনতার অভাবেই শীত মৌসুমেও ডেঙ্গু কমছে না।
বছরব্যাপী কর্মসূচি চালানোর পরামর্শ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, ডেঙ্গু এখন বছরব্যাপী রোগ। এ বছর চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাওয়ায় এসব ভাইরাস প্রতিরোধে বছরব্যাপী নির্মূল কার্যক্রম চালানো উচিত।
ডা. মুশতাক বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্রধান কাজটি হলো দ্রুত শনাক্ত করা। কিন্তু ডেঙ্গু শনাক্তে ল্যাব সুবিধা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় যুক্ত নেই। এ কারণে শনাক্ত হচ্ছে দেরিতে। ডেঙ্গুতে নারী-শিশুর মৃত্যু এমনিতেই বেশি। আর দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এখনো কার্যকর ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময় বুঝে পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে তবেই ডেঙ্গু কমানো যাবে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর