Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফিরে দেখা ২০২৪
আন্দোলনে প্রাণ দেয় তরুণরা, চসিকে বসেন শাহাদাত, চিন্ময়কাণ্ডে উত্তপ্ত চট্টলা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৫

চট্টগ্রামের সালতামামি-২০২৪। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ ছিল ‘বিদ্রোহের শহর’ চট্টগ্রাম; সেই আন্দোলনে একাধিক তরুণ দিয়েছেন অকাতরে প্রাণ। সরকার পতনের পর ক্ষমতাধর মন্ত্রী-এমপি, মেয়রসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের পলায়ন এবং মামলায় জিতে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেনের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়া। আকস্মিকভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার আদায়ের নেতা হিসেবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী নামে এক ‘সাধু’র উত্থান; তাকে ঘিরে সংঘাতে এক আইনজীবী খুন- মোটাদাগে এসব ঘটনাই বছরজুড়ে চট্টগ্রামকে আলোচনায় রেখেছে।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম

জুলাইয়ের শুরুতে সারাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা হয়, শুরু থেকে চট্টগ্রামও সেখানে শামিল ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসের পাশাপাশি নগরীতে সড়ক-রেলপথ আটকে আন্দোলন শুরু করেন। মধ্য জুলাইয়ে তাদের ঠেকাতে মাঠে নামে সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। সশস্ত্র অবস্থায় তাদের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার একাধিক ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ১৬ জুলাই নগরীর ষোলশহর, মুরাদপুরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আরও প্রকাশ্য হয়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে হামলে পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্তত ১২ জনের প্রাণ যায়। এরপর নগরীর নিউমার্কেট চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকা ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায়, অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্যে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল করে তাদের কর্মসূচির সফল সমাপ্তি টানে।

চট্টগ্রামে নিহতরা হলেন– চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত, আশেকান আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তারুয়া, জুতার দোকানের কর্মচারি শহীদুল ইসলাম, রিকশাচালক জামাল উদ্দিন, কাঠমিস্ত্রী মো. ফারুক, দোকান কর্মচারি মাহিন হোসেন সাইমুন, কার্টন ফ্যাক্টরির কর্মচারি মো. আলম, শ্রমিক মো. ইউসুফ, শিক্ষার্থী ইশমামুল হক ও শিক্ষার্থী ওমর বিন নুরুল আবছার।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের ক্ষমতাধর নেতাদের পলায়ন

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই মাঠ থেকে আউট হয়ে যান দলটির ক্ষমতাধর নেতা-মন্ত্রী, এমপি-মেয়র ও তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীসহ অনেক নেতাই ‘উধাও’ হয়ে যান। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের হদিস মেলে যুক্তরাজ্যে। বিদেশে কয়েক’শ ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে বিপুল টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

তবে ক্ষমতাধর সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ লতিফ, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীসহ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। তাদের কয়েকটি মামলায় একাধিকবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ক্ষমতায় থাকাকালে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতামূলক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত এসব নেতার গ্রেফতার নিয়ে চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে স্বস্ত্বি দেখা গেছে।

চসিক মেয়রের চেয়ারে শাহাদাত

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনি লড়াইয়ে জিতে গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৮ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সেই ফলাফল প্রত্যাখান করে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন।

গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে এ মামলার রায় দেন। এরপর ৮ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। ৩ নভেম্বর শপথ নেন তিনি। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে ১৭ অক্টোবর চসিক থেকে প্রশাসক বাদ দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহকে আন্দোলনের মুখে গত ৩১ অক্টোবর পদ ছাড়তে হয়। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসায় আলোচিত-সমালোচিত ফজলুল্লাহ’র ১৫ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে।

চিন্ময়ের উত্থান, আইনজীবীর মৃত্যু ও বিতর্কে ইসকন

গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার আদায়ের নামে হঠাৎ দৃশ্যপটে হাজির হন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী নামে এক ‘সাধু’। সনাতন ধর্মবিশ্বাসী সংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সংগঠক হিসেবে চিন্ময় পরিচিত ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি ‘সনাতনী জাগরণ জোট’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে সভা-সমাবেশ শুরু করেন।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চট্টগ্রাম, ঢাকা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে চিন্ময়ের নেতৃত্বে আট দফা দাবি আদায়ে সমাবেশ হয়। সেইসব সমাবেশে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বলেন। এমনকি সমাবেশগুলোতে জাতীয় পতাকা অবমাননার মতো ঘটনাও ঘটে। ফলে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে চিন্ময়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেফতার হন চিন্ময়। পরদিন ২৬ নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

এর পর তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বিক্ষোভ শুরু করেন তার অনুসারীরা। প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে থাকার পর একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখনই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে নগরীর লালদিঘীর পাড় থেকে কোতোয়ালি এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

সংঘর্ষের সময় সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়। এ ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় তোলে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হয়। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি এ ঘটনার জন্য ইসকন সদস্য ও সমর্থকদের দায়ী করে। ফলে বিতর্কের মুখে পড়ে যায় ইসকন। হেফাজতে ইসলাম ইসকন নিষিদ্ধের দাবি তোলে। তবে বিতর্কের মুখে পড়া ইসকন চিন্ময়ের দায় নিতে নারাজ। তাদের দাবি, চিন্ময়কে আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে। সেই চিন্ময় এখনও জেলহাজতেই আছেন। আইনজীবী খুনে থিতিয়ে গেছে চিন্ময়ের আন্দোলন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

আন্দোলন উত্তপ্ত চট্টলা চসিক চিন্ময়কাণ্ড তরুণ প্রাণ শাহাদাত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর