ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার ও জন্ম নিবন্ধনে অনীহা, কমেছে নারী ভোটার
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:০৮ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:১২
ঢাকা: দেশের মোট জনসংখ্যায় পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও ভোটারের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। বর্তমানে বাংলাদেশে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার কম প্রায় ৩০ লাখ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) খসড়া তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ১০৩ জন ও নারী ভোটার ৬ কোটি তিন লাখ ৫২ হাজার ৪১৫ জন এবং হিজরা ভোটারের সংখ্যা ৯৯৪ জন। এই হিসাবে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার কম ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮৮ জন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের হালনাগাদে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মোট ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫১৬ জন এবং নারী ছয় লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৪ জন ও হিজড়া ৬২ জন। এই হিসাব অনুযায়ী নারীর চেয়ে পুরুষ ভোটার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। হিসাব বলছে, গতবছর মোট ভোটার বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও জন্ম নিবন্ধনে অনীহা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতার অভাব, নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আগ্রহ বা সুযোগের অভারের কারণে নারী ভোটারের সংখ্যা কমছে। ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করবে নির্বাচন কমিশন। এই হালনাগাদ কার্যক্রমে নারী ভোটারের সংখ্যা বাড়াতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে নারীদের সম্পৃক্ত করে বিশেষ স্কোয়াড গঠনের পরামর্শও এসেছে তাদের কাছ থেকে।
যেসব কারণে কমেছে নারী ভোটার
২০২৪ সালের হালনাগাদ ভোটার তালিকায় নারী ভোটার কম হওয়ার আটটি কারণ চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। কারণগুলো হলো: নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অনীহা; হিন্দু অবিবাহিত মেয়েদের পিত্রালয়ে নিবন্ধন করতে অনীহা; অবিবাহিত, অনগ্রসর ও নিরক্ষর মেয়েদের ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ কম; বাবা-মা’র জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়া; রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র দূরবর্তী হওয়া; আবহাওয়া অনুকূল না থাকা; সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অজুহাতে ছবি তুলতে অনীহা; প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলাদের অসচেতনতা অন্যতম।
তবে এবারের ভোটার তালিকায় নারীদের অন্তর্ভুক্তির হার যেন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও থানা এবং সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী নারী ভোটারের সংখ্যা কম থাকার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে কমিশন। আমরা চেষ্টা করছি নারীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের ভোটার তালিকায় সম্পৃক্ত করতে।’ সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপগুলো নিতে পারলে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার নারী ভোটার বেশি হবে বলে মনে করছেন তিনি।
হালনাগাদ থেকে বাদ পড়ছে নারী পোশাক শ্রমিকরা
পোশাক কারখানা কাজ করেন বরিশালের সুমাইয়া বেগম। সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে তিনি বলেন, ‘আমি ভোটার হতে পারিনি। কারণ, আমি ঢাকায় থাকি। আর ভোটার তালিকা হয়েছে গ্রামে। সেজন্য আমি সময় মতো জানতে পারিনি। তাই ভোটারও হতে পারিনি।’ একই কথা বলেন ঢাকার আরেক পোশাকশ্রমিক সাথী আক্তার। তিনি জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় তিনি চট্টগ্রামের বাড়িতে ছিলেন না। তার পরিবারও তাকে গ্রামে গিয়েই ভোটার হতে বলেছিল। তাই আর ভোটার হওয়া হয়নি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যদি গার্মেন্টস থেকে ভোটার করা হয় তাহলে ভোটার তালিকায় নিজের নাম তুলতে পারব।’ তাদের মতো যারা এখনো ভোটার হতে পারেনি এ সমস্যার একটা সহজ সমাধান প্রত্যাশা করছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বিশাল নারী জনগোষ্ঠীর একাংশ পোশাক খাতে কর্মরত। ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম থেকে কোনো নারী পোশাক শ্রমিক যেন বাদ না পড়ে সে বিষয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। পোশাক শ্রমিকদের জন্য ইসির বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।’ যদি কারখানায় গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তাহলে কোনো নারী তালিকা থেকে বাদ যাবে না বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে কোনো পোশাক শ্রমিক যাতে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘খসড়া ভোটার তালিকায় দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার কম। এরই মধ্যে নারী ভোটার কম হওয়ার আটটি কারণসহ বেশকিছু অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন।’ এবারের হালনাগাদ কার্যক্রমে নারী পোশাক শ্রমিকদের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে আরও বেশি নারীদের সম্পৃক্ত করে একটি বিশেষ স্কোয়াড গঠন করা যেতে পারে। হালনাগাদ কার্যক্রমটি কীভাবে আরও স্বচ্ছ করা যায় সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার জোট ফেমার প্রধান মুনিরা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে যেন কেউ ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়ে সে বিষয়েও ইসিকে কাজ করতে হবে। এসব বিষয়ে নারীদের মাঝে কীভাবে আরও সচেতনতা বাড়ানো যায় সেদিকটি নির্বাচন কমিশনকেই দেখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে ভোটার এডুকেশন প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করতে পারে। যারা ভোটার পর্যবেক্ষক তাদের সঙ্গে নিয়ে এই প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।’ এই কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত পরিচালনার কথাও বলেন ফেমা প্রধান মুনিরা খান।
সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম
কুসংস্কার জন্ম নিবন্ধনে অনীহা ধর্মীয় গোঁড়ামি নারী ভোটার নির্বাচন কমিশন পোশাক শ্রমিক