বিতর্কিত নির্বাচন
শুধু ইসি নয়, ৩ নির্বাচনের দুর্নীতি তদন্তে নামবে দুদকও
২০ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৪৪ | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:২৯
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত গত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন তদন্ত করবে নির্বাচন কমিশন— এমন ঘোষণা আগে থেকেই আছে। এবার ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের নানান অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শিগগিরই কমিশন সভায় সাবেক সিইসি ও ইসিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অংশ না নেওয়ায় ‘একতরফা’ ভোট হয়। যে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৫৩ জন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও ‘রাতের ভোট’ বলে অভিহিত করা হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি ও শরিকরা সাতটি আসন পায়, যা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগের সন্দেহকে দৃঢ় করে তোলে। এ ছাড়া, সর্বশেষ ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগের ‘ডামি’ প্রার্থী নিয়ে নির্বাচন করে। এতে টানা চাতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় আসে দলটি। ফলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসব নির্বাচনের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে যাচ্ছে ইসি ও দুদক।
উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে। একাদশ সংসদ নির্বাচন করেছে কেএম নুরুল হুদার কমিশন। আর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। গত ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পদত্যাগ করে।
সূত্র বলছে, জাতীয় নির্বাচনে কী কী অনিয়ম হয়েছে সেসবের খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ তছনছ বা নয়-ছয় করার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অন্যদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সম্পদের তথ্যও জানতে চাওয়া হবে বলেও জানা গেছে।
সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতামতের ঊর্ধ্বে গিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। হাজার কোটি টাকায় কেনা ইভিএম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ ক্ষতির বিষয়টিও অনুসন্ধানের আওতায় আসতে পারে। দুদক জানায়, গত তিনটি নির্বাচনে মোট কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং কোনো অর্থ বিনা কারণে খরচ হয়েছে কিনা- এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে একটি টিম খোঁজ কাজ শুরু করেছে বলে জানা েগছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ২৬৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কমিশন ব্যয় করে ৭০০ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে কমিশন ব্যয় করেছিল প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ এত বেশি নির্বাচনি ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, নির্বাচন পরিচালনা খাতে ব্যয় বেড়েছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে নিরাপত্তা ব্যয়ও। এ ছাড়া, বাড়তি ভোটার, বাড়তি ভোট কেন্দ্রের হিসাবও দেখান তিনি।
এদিকে বিগত তিন নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ বিষয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিগত তিনটি নির্বাচনই যে বিতর্কিত ছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর্থিক অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানান বিষয়ে ছিল অনেক সমালোচনাও। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে এই বিষয়ে অনুসন্ধানে নামছে তা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে খুবই ভালো পদক্ষেপ।’ এ ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ শুরু করেছে। সেখানে এমন পদক্ষেপ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও দুর্নীতি বা অনিয়মে করলে যে তাকে আইনের আওতায় আনা যায়, দুদকের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তা ফের প্রমাণ হবে।’
ইফতেখারুজ্জামান যোগ করেন, ‘সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে বা রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকেন সে বিষয়ে অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে। তবে এটা বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ। এখানে কে কোন ভূমিকা পালন করেছেন, কীভাবে অনিয়মগুলো হয়েছে, কোথায় কোথায় কোন খাতে হয়েছে- সেসব বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে দুদক যেন তার এখতিয়ার বহির্ভূত কোনো কাজ না করে।’ সেইসঙ্গে কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়েও বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিগত সময়ে যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতির সঙ্গে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, সেসব পরিপূর্ণভাবে জানার অধিকার জনগণের আছে। এ বিষয়ে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। নির্বাচনের নামে কী কী হয়েছে। কোটি কোটি টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে- তার হিসাবে নেওয়াটাও জরুরি।’ সেইসঙ্গে শুধু সাবেক সিইসি-ইসিরাই নন, বিতর্কিত নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
এর আগে, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ ও প্রতারণামূলক নির্বাচনের আয়োজন করায় চট্টগ্রামের আদালতে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সচিবদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন সাবেক বিএনপি নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা একরামুল করিম। সেই মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল ২০১৪ সালে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদকে। এর পর পর্যায়ক্রমে আসামি করা হয়েছে ওই নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বে থাকা চার নির্বাচন কমিশনার ছাড়া ২০১৮ সালে ও ২০২৪ সালে দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আইয়ালসহ কমিশনের সচিব ও অন্য সদস্যদের। মামলায় আরও আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ তিন সংসদে থাকা সংসদ সদস্যদেরও।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও ইন্ধনে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জনগণের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দেশের সংবিধান ও আইনকে লঙ্ঘন করে একপেশে, জনগণের অংশগ্রহণবিহীন ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু অনির্বাচিত লোককে সংসদ সদস্য ঘোষণা করেন। পরে তাদের মন্ত্রী ও স্পিকার ঘোষণা করা হয়। দেশের মানুষ ভোট দিতে না পারায় নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গণতন্ত্র। দেশে স্বৈরচারী লুটেরা ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা।
সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম