ভরণপোষণ পাচ্ছেন না এরিক, মামুনের দাবি দিচ্ছেন
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০৫
ঢাকা: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া ‘এরশাদ ট্রাস্ট’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ট্রাস্টের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মামুনের সঙ্গে এরশাদপুত্র এরিকের লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইয়ে এরিকের সঙ্গে রয়েছেন তার মা বিদিশা সিদ্দিক। অভিযোগ উঠেছে, ট্রাস্টের টাকায় এরিকের ভরণপোষণের খরচ বহন করার কথা থাকলেও তিনি তা পাচ্ছেন না। এরশাদ ট্রাস্ট থেকে নাকি তাকে কিছুই দেওয়া হয় না। কিন্তু মামুন বলছেন, ট্রাস্ট থেকে মাসে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা এরিককে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, ট্রাস্টের কাগজপত্র ও হিসাব-নিকাশ জানতে কাজী মামুন সাহেবের সঙ্গে এরিক তার আইনজীবী নিয়ে বসতে চান। কিন্তু কাজী মামুন নাকি তারিখ দিয়েও আসেন না। এদিকে এরশাদপুত্র এরিক গুলশান থানায় কাজী মামুনের নামে ট্রাস্টের কাগজপত্র ও চেক বই চুরির অভিযোগে মামলা করেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এরিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার জীবন এখন দুর্বিষহ। আমি খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছি। আমাকে সাহায্য করুন। এরশাদ ট্রাস্টের টাকায় আমার চলার কথা। কিন্তু আমি ট্রাস্ট থেকে এক টাকাও পাই না। খুবই কষ্টে চলছে আমার জীবন। আমার মা বিদিশা সিদ্দিক আমার খরচ বহন করছেন।’ তিনি বলেন, ‘প্রতি দুই বছর পর পর ট্রাস্টের কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। আমি গুলশান থানায় একটি মামলা ও একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
এরশাদ ট্রাস্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে এরিকের মা বিদিশাকে প্রশ্ন করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ট্রাস্টের সম্পত্তির ওপর আমার কোনো লোভ-লালসা নেই। এরিককে ট্রাস্ট থেকে একটি টাকাও দেওয়া হয় না। এরিক সাবেক রাষ্ট্রপতির ছেলে। তার স্ট্যাটাস ধরে রাখতে আমার ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হয়েছে। এ ছাড়া, এরিকের নিজের একটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান আছে। তা দিয়ে সে চলছে। সবাই জানে এরিক শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী।’
বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করছেন বিদিশা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকতে তো আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে মা থাকবে- এটি তো আইনেই আছে। আর প্রেসিডেন্ট পার্কে আমার অবস্থান বিষয়ে বোর্ডের কারও সম্মতি আছে কি নেই, সে বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
এ সব বিষয় নিয়ে কাজী মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরশাদ ট্রাস্ট নিয়ে অনেক আগে থেকেই গ্যাঞ্জাম চলছে। এরশাদ ট্রাস্ট থেকে প্রতিমাসে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা এরিককে দেওয়া হয়। ট্রাস্টের নগদ ক্যাশ ১৫ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা। রংপুরে একটি কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে। এই কোল্ডস্টোরেজের জমিসহ দাম প্রায় ২৫ কোটি টাকা। যদিও এটি একটি লস প্রজেক্ট।’
এদিকে কাজী মামুনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে গুলশান থানার দারোগা মো. হারুনুর রশিদ। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “এরিক এরশাদ ‘এরশাদ ট্রাস্ট’র সঙ্গে জড়িত সকলের নামে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি বলেছেন যে, ট্রাস্টের চেয়ারম্যানসহ সকলের সঙ্গে বসতে চাচ্ছে চান। ট্রাস্ট কীভাবে পরিচালনা হচ্ছে, কত টাকা আয় হচ্ছে ইত্যাদি জানতে চান।’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে কাজী মামুনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বসার জন্য দুই বার সময় দিয়েও বসেননি। তিনি বলেছেন, বিষয়টি উপর থেকে দেখবে। এরপর আর কাজী মামুন কোনো যোগাযোগ করেননি। এরিক খুবই কষ্টে চলছে- এতটুকু জেনেছি। তাকে ট্রাস্ট থেকে যে প্রতি মাসে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয় এর কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি কাজী মামুন। ফলে পরবর্তী পদক্ষেপ আইন অনুযায়ী হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তার নিজের নামে একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তিও উইল করে যান। জাপা’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের এই ট্রাস্টে কী আছে- এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর সময় কোনো কৃষিজমি ছিল না এরশাদের। ঠাকুরগাঁওয়ে ধর্মগড়ে ১২০ বিঘার মতো কৃষিজমি ছিল। সেই জমি অনেক আগেই এতিমদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এতিমখানায় অধ্যয়ন করা অনাথদের ১০ বিঘা জমি লিখে দিয়েছিলেন তিনি।
কৃষি জমি না থাকলে এরশাদের ট্রাস্টের সম্পদে পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। ট্রাস্টের নামে এরশাদ উইল করে গেছেন তার নামে থাকা সব এফডিআর, রংপুরের পদাগঞ্জে অবস্থিত পল্লীবন্ধু কোল্ড স্টোরেজ, বারিধারার ফ্ল্যাট (প্রেসিডেন্ট পার্ক, যেখানে তিনি নিজে থাকতেন), গুলশানের ফ্ল্যাট, বনানী বিদ্যা নিকেতনের বিপরীতে অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট, বনানী ইউআই শপিং কমপ্লেক্সের দু’টি দোকান, ৬৫ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রংপুর শহরে বাসভবন (পল্লী নিবাস) ও নিজের নামে কেনা পাঁচটি গাড়ি।
তবে ট্রাস্টে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সে বিষয়ে জানা নেই বলেই জানালেন জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের সময়ে চাচাত ভাই সামছুজ্জামান মুকুলকে কিছু শেয়ার লিখে দিয়েছিলেন। সে কারণে পুরো কোল্ড স্টোরেজ ট্রাস্টে লিখে দিলেও এর থেকে প্রাপ্ত আয়ের ২০ শতাংশ হিস্যা যায় মুকুলের নামে। বাকি ৮০ শতাংশ মুনাফা জমা হয় ট্রাস্টের ফান্ডে। তবে কোল্ড স্টোরেজের মূলধনে মুকুলের কোনো ভাগ নেই।
ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের বোর্ড রাখার বিধান করা হয় ট্রাস্ট গঠনের সময়। প্রয়াত এরশাদ ছাড়া ট্রাস্টের বাকি সদস্যরা ছিলেন এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ, ভাতিজা মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) খালেদ আক্তার, (তিনি মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন) ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ও চাচাত ভাই সামছুজ্জামান মুকুল (রংপুরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক)। এরশাদের মৃত্যুর পর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) খালেদ।
ট্রাস্টিদের কোনো রকম সম্মানি বা ভাতা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি ট্রাস্টের গঠনতন্ত্রে। বলা হয়েছে, বোর্ডের সদস্যরা কাজ করবেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। ট্রাস্টের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি বা মালিকানা পরিবর্তনেরও কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ট্রাস্ট পরিচালনার নীতিমালায় বলা হয়েছে, মুনাফার অর্থে পরিচালিত হবে এই ট্রাস্ট। ট্রাস্টের মুনাফায় প্রথমত ব্যয় হবে এরিক এরশাদের ভরণপোষণে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এরশাদের অবর্তমানে এরিকের ভরণপোষণের বিষয়টি। এরিখের পরবর্তী প্রজন্মও (যদি থাকে) এখান থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। তবে এরিখের পরবর্তী প্রজন্ম না থাকলে সেক্ষেত্রে পুরো সম্পদ চলে যাবে ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে।
এরিকের ভরণপোষণের পর উদ্বৃত্ত অর্থ সেবামূলক কাজে ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে হঠাৎ কোনো মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলে তাদের পাশে দাঁড়াবে ট্রাস্ট। দুঃস্থ অসহায়, এতিমদের আজীবন ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু এফডিআর থেকে বছরান্তে আয় আসবে। সে কারণে ট্রাস্টের আর্থিক বিবরণী অডিট করার বিধান রাখা হয়েছে। পার্টি সূত্র বলছে, এরশাদ তার ট্রাস্ট গঠন করার সময় দলের কাউকে তেমন একটা যুক্ত করেননি এই প্রক্রিয়ায়। ফলে দলের নেতাদের তেমন কোনো প্রভাবই এই ট্রাস্টে নেই।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম