Saturday 07 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গোল করো না, গোল করো না…


১৮ জুন ২০১৮ ১৭:৫৪
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পলাশ মাহবুব ।।

বাহার ভাই, আমাদের এলাকার বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। বিশিষ্ট এই কারণে যে আমাদের এলাকায় আসলে তেমন কোনও চিন্তাবিদ নেই। সবাই আছে যার যার ধান্দায়। ছোটরা ব্যস্ত ফেসবুক নিয়ে, মা-খালারা আছেন সিরিয়াল নিয়ে আর বাপ-চাচারা ব্যস্ত ‘ঘানি’ টানা নিয়ে। সংসারের ঘানি আরকি। এরমধ্যে বাহার ভাই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি কিছুটা রাখাল প্রজাতির। তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। সারাক্ষণ দেশ-সমাজ, পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। ফলে আমরা বাহার ভাইকে দাম দেই। ফলে দামের ‘ট্যাগ’ হিসেবে আমরা বাহার ভাইকে বিশিষ্টতে ভূষিত করি। আর আমাদের বাহার ভাই জানেন, ‘ত্যাগ’ আর ‘ট্যাগ’ দুটোতেই প্রকৃত সুখ। বাহার ভাই প্রকৃত সুখী মানুষ।

বিজ্ঞাপন

বাহার ভাইয়ের চিন্তার একটি ধারা আছে। তিনি সিন্ধু সেচে মুক্তো আনার মানুষটি নন। তিনি সব সময় সময়ের সাথে থাকেন। সাধারনত সমসাময়িক বিষয়-আশয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন বাহার ভাই। গরমের সময়ে বাহার ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনা থাকে মিল্লাত ঘামাচি পাউডার কেন্দ্রিক। ঘরে ঘরে কিভাবে এক নাম্বার মিল্লাত ঘামাচি পাউডার পৌঁছে দেয়া যায় বাহার ভাই ব্যস্ত থাকেন তাই নিয়ে। তেমনি শীতের সময় তার ভাবনার জায়গা দখল করে শীতার্ত মানুষ আর শীত বস্ত্র। শীতে তিনি শ্লোগান তোলেন- জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো। মানে, শীত তাড়ানোর আগুন আরকি। বাহার ভাইয়ের সাথে আমরাও শ্লোগান তুলি। আমরা মূলত সবসময়ই বাহার ভাইয়ের সাথে তাল মেলাই। বাহার ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনা আমাদের ভালো লাগে।

চিন্তা হচ্ছে নতুন শিশুর মতো, তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এসেছে বিশ্বকাপ সুতরাং তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে পাশে ঠেলে বাহার ভাইয়ের চিন্তার জায়গা দখল করে নেয় বিশ্বকাপ। কিছুদিন ধরে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বেশ ভাবনার মধ্যে আছেন বাহার ভাই। যার রেশ পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্বকাপ নিয়ে বাহার ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনা বেশ বাহারি। আজ মেসির ভুল নিয়ে ভাবছেন তো কাল ভাবছেন নেইমারের চুল নিয়ে। আর বাহারি চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শুরুতেই দারুণ চমক দিয়ে দিলেন বাহার ভাই। তিনি ফুটবলের একটা নতুন নামকরণ করে ফেললেন- ‘গোলমাল’।
গোলমাল!
ফুটবলের নতুন নাম শুনে আমরা মুখটাকে সম্ভাব্য সম্পূর্ণ হা করে বাহার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই। ফুটবলের নাম ‘গোলমাল’ হয় কোন যুক্তিতে!!
আমাদের মুখে হা আর কপালে ভাঁজ পরতে দেখে বাহার ভাই হাসেন।
যুক্তি আছেরে। যুক্তি আছে। আচ্ছা শোন, বলতো ফুটবল বস্তুটার আকৃতি কেমন?
আমরা একসঙ্গে মুখ বাঁকিয়ে বললাম, কেমন আবার, ফুটবলতো গোওওওল।
হুম। ফুটবল আকৃতিতে গোল। আর ফুটবল হচ্ছে একটা বস্তু মানে প্রোডাক্ট মানে খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ‘মাল’। ঠিক কিনা?
আমরা মাথা নেড়ে বললাম, হুম। তাও ঠিক।
বাহার ভাই ডাবল মাথা নেড়ে বললেন, তাও যদি ঠিক হয় তাইলে কাম টু দা পয়েন্টে আসো। ফুটবল যদি আকৃতিতে গোল একটি মাল হয় তাহলে ফুটবলকে ‘গোলমাল’ বলা যাবেনা কেন? হোয়াই!
বাহার ভাইয়ের যুক্তি শুনে আমাদের মুখের হা এবার বিপদসীমা অতিক্রম করে। আরে তাইতো . . . ফুটবলকে তো ‘গোলমাল’ বলাই যায়।
সরল অঙ্ক মেলানোর মতো হাসি দিয়ে বাহার ভাই আমাদের দিকে তাকান।
কি… মিললো তো?

আমরা মুগ্ধ হয়ে বাহার ভাইয়ের হাসি দেখি এবং পুনরায় বাহার ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনার গভীরতায় মুগ্ধ হই এবং মনে মনে স্বীকার করে নেই বাহার ভাই আসলেই একটা ‘মাল’। পাশাপাশি আমরা এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হই যে ফুটবল নিয়ে বাহার ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনা আসলেই ব্যতিক্রম। বাহার ভাই ফুটবল নিয়ে যত ভাববেন ততই উপকৃত হবে ফুটবল বিশ্ব তথা ফিফা। আমরা বাহার ভাইকে ভাবনায় উৎসাহ দেই।

উৎসাহ পেয়ে বাহার ভাই পুনরায় ভাবতে শুরু করেন। তার সর্বশেষ ভাবনার বিষয় ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে বাঙালির উন্মাদনার কারণ এবং করণীয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বাহার ভাই বের করলেন, এই উন্মাদনা মূলত এক শূণ্যতার বহিঃপ্রকাশ।
শূণ্যতার বহিঃপ্রকাশ! বলেন কি!
আমরা পুনরায় বাহার ভাইয়ের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসি।
বাহার ভাই রোনালদোর ফ্রি কিকের মতো লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। অবশ্যই শূণ্যতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে নেই, এটা একটা বিরাট শূন্যতা। আর প্রকৃতি যেহেতু শূণ্যতা পছন্দ করে না তাই আমরা হাহাকার ঢাকতে ব্রাজিল-আর্জেন্টনা নিয়ে মাতামাতি করি। একে বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। আফসোস।
দীর্ঘশ্বাস দিয়ে আফসোস ঢেকে বাহার ভাই আমাদের দিকে তাকান। বাহার ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাস আমাদেরও ছুঁয়ে যায়। আমরা দ্বিগুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। আহারে।
বাহার ভাই যেহেতু ফুটবল ভাবনার মধ্যে আছেন, তাকে ভাবনার গভীরে যেতে উৎসাহ দেই আমরা। আমাদের মধ্যে একজন জানতে চায়- আচ্ছা বাহার ভাই, এই যে আমরা ফুটবল খেলায় ভালো না এর পিছনের কারণটা আসলে কি? এ নিয়ে কি আপনি কিছু ভেবেছেন?
বাহার ভাই ঝিম মেরে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবেন। তারপর মাথা তুলে তাকান।
অবশ্যই ভেবেছি। শুধু ভবিষ্যত না, অতীতের ভাবনা ভাবাও জ্ঞানী লোকের কাজ। তাই পুরনো হলেও ইস্যুটা নিয়ে আমি ভেবেছি। এবং ভেবে-চিন্তে শেষ পর্যন্ত একটা কারণই খুঁজে পেলাম বুঝলি- ফুটবলে আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ আসলে একটি কবিতা।
কবিতা! কবিতার কারণে আমরা ফুটবলে পিছিয়ে আছি! কি বলেন বাহার ভাই?
আমাদের বিস্ময়কে আমলে না নিয়ে বাহার ভাই বললেন, অবশ্যই কবিতা। ছোটবেলায় আমাদের কবিতা শেখানো হয়, গোল করোনা গোল করোনা… ছোটন ঘুমায় খাটে। কি, তোরাই বল, শেখানো হয় না?
আমরা মাথা নেড়ে বললাম, হুম। তা অবশ্য শেখানো হয়। কিন্তু তার সাথে ফুটবলের কি সম্পর্ক?

বাহার ভাইয়ের মুখে বিজ্ঞের হাসি।
সম্পর্ক আছে। ছোটবেলাতেই যদি মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় হয় যে, গোল করো না গোল করোনা … তাহলে গোলটা হবে কি করে শুনি? আর গোলই যদি না হয় তাহলে ফুটবলে আগাবে কি করে, হুম? এজন্যই আমরা ফুটবলে ভালো না। বুঝতে পেরেছিস?
আমরা বাহার ভাইয়ের কথার ‘ডি-বক্স’ খুঁজে না পেয়ে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকি।

পলাশ মাহবুব : কথসাহিত্যিক ও নাট্যকার। উপ-সম্পাদক, সারাবাংলা।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর