হরিণ বাড়লেও থেমে নেই শিকার
সুন্দরবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শিকারিদল
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৫
বাগেরহাট: দিন দিন সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও কমছে না শিকার। হরিণ ধরতে চোরাশিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বনে দেড় শতাধিক শিকারিদল দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কয়েক বছরে বনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে, কমেছে হরিণ শিকার। বেড়েছে অর্ধলক্ষাধিক হরিণ।
এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠছে চোরাশিকারিরা চক্র। খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলায় বেশি হরিণ শিকার হয়। বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারে লিপ্ত।
এছাড়া মোংলার চিলা, জয়মনি, বৈদ্যমারী, কাটাখাল কুল, বাঁশতলা, কাটাখালী, মোরেলগঞ্জের জিউধরা, গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী, শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, চালিতাবুনিয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বেশ কিছু গ্রামে হরিণ শিকারিদের তৎপরতা রয়েছে।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে অবৈধভাবে হরিণ শিকার করে মাংস নিয়ে ফিরছিল শিকারির দল। এ সময় সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীদের দেখে পালিয়ে যায় শিকারিরা। পরে ৮০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। সুন্দরবনের সত্যপীরের খাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ৭ জানুয়ারি মোংলার ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ছয়জনকে আটক করে কোস্টগার্ড। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা বাজার এলাকায় প্রায় ৩০ কেজি হরিণের মাংসসহ একজনকে আটক করা হয়।
যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হচ্ছে, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার হচ্ছে। মাঝেমধ্যে দুই একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। আর যারা আটক হন- তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বনজসম্পদ আহরণসহ নানা উপায়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কমেছে। যে কারণে বনজীবীদের কেউ কেউ জীবীকার তাগিদেও এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কয়েকটি চোরাশিকারি চক্র।
স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় পদ্ধতিতে মাংস, চামড়া, মাথাসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে পাচার করে চোরাশিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস। চোরাশিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করেন। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অবৈধ জেনেও হরিণের মাংস কেনেন মানুষ। কেউ কেউ স্বজনদের হরিণের মাংস উপহার দেন। আবার বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করা হয়। হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ ঘর সাজান।
কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মুসফিক উস সালেহিন জানায়, সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোংলা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাসে তল্লাশি চলিয়ে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ছয়জন চোরাচালানকারীকে আটক করা হয়।
আটক ব্যক্তিরা হলেন, মো. রবিন, তাইজুল ইসলাম, সোহেল হোসেন, সাইদুল ইসলাম, কল্পনা আক্তার নাজু ও মুক্তা আক্তার। তাদের সবার বাড়ি ঢাকার কেরানিগঞ্জে। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা বাজার এলাকায় প্রায় ৩০ কেজি হরিণের মাংসসহ ইকবাল মোড়ল নামে এক তরুণকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ইকবাল পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের বাসিন্দা।
খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলছেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করা হচ্ছে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নিবাহী শুভ্র শচীন বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণ শিকারিদের তথ্যে দেখা গেছে, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোয় দেড় শতাধিক শিকারিদল রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরাশিকারিরা এ সময় তৎপর হয়। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের।’
তিনি বলেন, ‘শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণেই মাংসসহ হরিণ শিকারি ধরা পড়ছে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণিরক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্যপ্রদানকারীকে সরকার পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদনের ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হচ্ছে। হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল, দস্যু কমার পাশাপাশি রাসমেলা বন্ধ হওয়ার কারণে হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে ‘
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি।
সারাবাংলা/এসআর