অবশেষে বনে ফিরছে সেই নিঃসঙ্গ ভাল্লুকসহ ১৭ প্রাণী
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৩:৫৩
রাঙ্গামাটি: ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটিতে মিনি-চিড়িয়াখানা স্থাপনের পর সেখানে আনা হয় কয়েকটি ভাল্লুকছানা। প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি সময়ে ভাল্লুকগুলোর একটি বাদে সবগুলো মারা যায়। এরপর একটি ভাল্লুকের দিন-রাত পেরিয়েছে একাকীত্বেই। অবশেষে সেই একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার অবসান হলো। নিঃসঙ্গ ভাল্লুকটিকে উদ্ধার করে বনে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। একইসঙ্গে মিনি-চিড়িয়াখানাটির অন্য সব বুনো প্রাণীগুলোকেও উদ্ধার করা হয়েছে।
সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের একটি দল রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পরিচালিত মিনি-চিড়িয়াখানাতে গিয়ে বন্যপ্রাণীগুলো উদ্ধার করে। এরপর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারের চকরিয়ায় অবস্থিত ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে। এর আগে অবশ্য, জেলা পরিষদই বন বিভাগের বিশেষ এই ইউনিটকে বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরের কথা জানায়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, জেলা পরিষদ পরিচালিত মিনি-চিড়িয়াখানাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায় ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট। যদিও অনুমোদন পাওয়ার আগে থেকেই সেখানে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আনতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন সময়ে রোগাক্রান্ত হয়ে, খাবার সংকট ও যথাযথ পরিচর্যার অভাবে কিছু বন্যপ্রাণী মারা গেছে। চিড়িয়াখানাটি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আয়বর্ধক প্রকল্প না হওয়ায় এটির প্রতি মনোযোগী ছিল না প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারি বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক বরাবর চিঠি লিখে মিনি-চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণীগুলো বন বিভাগকে হস্তান্তরের কথা জানায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার। চিঠিতে তিনি জেলা পরিষদ বন বিভাগকে জানান, কিছু বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করে ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ একটি মিনি-চিড়িয়াখানা স্থাপন করে জেলা পরিষদ। চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বর্তমানে অভিজ্ঞ জনবলের অভাবের কারণে প্রতিপালন ও সংরক্ষণে সমস্যা হচ্ছে বিধায়, বন বিভাগের নিকট হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটি।
জেলা পরিষদের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, মিনি-চিড়িয়াখানাটিতে প্রাণীর সংখ্যা ১৯টি। এর মধ্যে একটি ভাল্লুক, পাঁচটি বন মোরগ, চারটি বানর, একটি হরিণ, ছয়টি কচ্ছপ ও দু’টি সজারু রয়েছে। তবে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট জেলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ১৯টি প্রাণীর মধ্যে দুটি বাদে ১৭টি উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করে প্রাণীগুলোর কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে কোয়ারান্টাইন ও যথাযথ চিকিৎসা শেষে বনে অবমুক্ত করা হবে।
স্থানীয়রা বলছেন, রাঙ্গামাটি জেলা শহরের এক প্রান্তে সুখীনীলগঞ্জ এলাকায় নিরিবিলি প্রাকৃতিক-পরিবেশের মধ্যেই চিড়িয়াখানা প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশে স্থাপন করা হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে উদ্যোগটি বিফলে গেছে। উল্টো বুনো প্রাণী ধরে এনে লোহার খাঁচায় বন্দি করা করায় খাবার ও অসুখে মারা গেছে সেগুলো।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পরিচালিত মিনি-চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণী পালনকারী সোনাবী চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে বন বিড়াল, খরখোস, ভাল্লুক, হরিণ, গুঁইসাপ ছিল। কিছু কিছু প্রাণী মারা গেছে। আমি জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি প্রাণীগুলো যেন সুন্দরভাবে সারাজীবন থাকতে পারে। ভাল্লুকটাকে নিয়ে যাচ্ছে, এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। ছোট থেকে আমি পালন করছি। ডাক দিলেই সে আমাকে চেনে। কুকুরের ছানার মতো ছিল; এখন তো অনেক বড় হয়েছে।’
বন অধিদফতরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকারনাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে ভাল্লুকের শারীরিক অবস্থা ভালো। হরিণের অবস্থা মোটামুটি, চামড়ায় কিছুটা সমস্যা আছে। বানরের চামড়ায় সমস্যা আছে। অন্যান্য প্রাণীগুলো মোটামুটি আছে। এগুলোকে আমরা সাফারি পার্কে নিয়ে যাব। আমি মূলত সাফারি পার্কেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আছে, প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়। সে কারণেই এখানে আসা। বন বিভাগের প্রাণী চিকিৎসক কম থাকায় আমাকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি সবখানেরই যেতে হয়।’
ভাল্লুকটির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিঃসঙ্গ থাকলে অবশ্যই ভাল্লুকটির মধ্যে মানসিক প্রভাব পড়বে। যদি ছোট অবস্থা থেকেই এখানে থাকে মানুষের সংস্পর্শে, তাহলে তার মনের মধ্যে প্রেসার কম পড়বে। পরিবেশ-প্রকৃতি বোঝার পর যদি প্রাণ কে আলাদা করা হয় তাহলে সে প্রাণীর মনের মধ্যে চাপটা বেশি পড়ে। ভাল্লুকটি যেহেতু ছোট অবস্থা থেকেই মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তার এত সমস্যা হবে না। তবে ভাল্লুকটির আচরণগত কিছু পরিবর্তন হবে।’
পরিবেশবাদীরা বলছেন, মিনি-চিড়িয়াখানার নামে প্রায় বিগত দুই দশক ধরেই বন্যপ্রাণীগুলো আটকে রাখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এটি নিয়ে বিগত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রসঙ্গ উঠলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি জেলা পরিষদ। মিনি-চিড়িয়াখানাটিতে শিশু-পার্ক তৈরিসহ নানান আলাপ উঠলেও কোনোটিতে নজর দেয়নি বিগত পর্ষদ। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর তারা বন্যপ্রাণীগুলো বন বিভাগকে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়।
বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দ্বীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রধান বন সংরক্ষকের মাধ্যমে এটি অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন উনারা বলেছেন কিছু প্রাণী রাখতে চান, পরে নিঝুম দ্বীপ থেকে কিছু হরিণ আনার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে বন অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু প্রাণী এনেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য যে প্রাণীগুলো এসেছে, সেগুলো কীভাবে এসেছে সেটি বন অধিদপ্তর জানে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার প্রাণীর ওপর যথেষ্ট অবহেলা ও পরিচর্যার অভাব রয়েছে। তাই, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটই প্রথম প্রাণীগুলো উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়। জেলা পরিষদ বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরের জন্য সম্মত হওয়ায় আমরা আজ উদ্ধার করেছি। বন্যপ্রাণীগুলো প্রথমে কক্সবাজারের চকরিয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নিয়ে পর্যাপ্ত কোয়ারাইন্টানে (সংগনিরোধকরণ) রাখা হবে। এরপর যেগুলো প্রকৃতিকে অবমুক্ত উপযোগী সেগুলোকে অবমুক্ত করা হবে। যেগুলোকে বেষ্টনীতে রাখতে হবে, সেগুলোকে বেষ্টনীতে রাখা হবে।’
আরেক বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস সারাবাংলা বলেন, ‘২০০৮ সালে মিনি-চিড়িয়াখানাটি স্থাপন করার পর এখানে কিছু বন্যপ্রাণী রাখা হয়। বর্তমানে এটি ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন পরিপন্থি। এই আইনের অধীনে কোনো ধরণের দেশীয় প্রজাতির বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়, বন্দি রাখা, লালন-পালন করা আইন পরিপন্থি। এখান থেকে বন্যপ্রাণীগুলো জব্দ করে আমরা ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নিয়ে যাব।’
সারাবাংলা/পিটিএম