স্টলসজ্জায় নান্দনিকতার পাশাপাশি ঐতিহ্যকে প্রাধান্য
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৪৪ | আপডেট: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৫০
ঢাকা: ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি’—কথাটি বইমেলার স্টলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে সকল স্টল কিংবা প্যাভিলিয়নের সজ্জা সুন্দর সাধারণত দর্শনার্থী পাঠকরা সেগুলোতে আগে প্রবেশ করেন। তাই প্রতি বছরই প্রকাশকরা তাদের স্টল নির্মাণের সময় বিষয়টি মাথায় রাখেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রকাশকরা চেষ্টা করেছেন নতুনত্ব আনার।
কালো রঙের বোর্ডের ওপর লাল ছোপ ছোপ দাগ। তার ওপর কাঁটাতার। তারও ওপরে বাংলা বর্ণমালা। নিচে পিলারের গায়ে তাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ। এমন থিম ব্যবহৃত হয়েছে ‘অন্যপ্রকাশ’র প্যাভিলিয়নে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সিরাজুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ। সেই একুশ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ভাষার অধিকারের দাবিতে। তাই একুশ মানে শোক আর কালো শোক থেকে রক্তলাল শক্তির উত্থান। কাঁটাতারের ব্যারিকেড ভেঙে মুক্তি পেয়েছে বর্ণমালারা। বাঙালির সেই সংগ্রাম আর সাফল্যের গৌরবগাথা প্রতীকী রূপে মূর্ত হয়েছে আমাদের এবারের সজ্জায়।’
প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘরের প্যাভিলিয়ন নির্মিত হয়েছে বাঁশ দিয়ে। ভিতরের একটা অংশে কিছুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের মিনারের প্রতিরূপ। ওপরের অংশ সাধারণ টালি দিয়ে সাজানো। খুঁটিগুলোতে কালো রঙের ব্যবহার। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানালেন, তারা চেয়েছেন অতিসাধারণ কিন্তু একটি থিমে প্যাভিলিয়ন সাজাতে। সে চেষ্টা থেকে এমন ডিজাইন বেছে নেওয়া।
‘পুথি’ মানে বই বা পুস্তক। আর তা যদি কারো মাথার ওপরে ছায়া হয়ে থাকে তাহলে সে মানুষটি পথ হারাবে না। ঠিক এমন ভাবনা থেকে ‘পুথিনিলয়’ তাদের প্যাভিলয়ন সাজিয়েছে। যেখানে উপরিভাগে তারা রেখেছেন বিশাল বই আকৃতির ছাদ। নিচেও রেখেছেন বইয়ের প্রতিকৃতি।
পথিক ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য একধরণের ঘর নির্মাণ করা হত পথের ধারে। যাতে ব্যবহৃত হত বাঁশ। সেরকমই বিশ্রামাগারের মত করে বাঁশ দিয়ে স্টল নির্মাণ করা হয়েছে ‘আকাশ’র। অতিরিক্ত কোনো সজ্জায় না গিয়ে শুধু এক কোণায় প্রকাশনা সংস্থার লোগো রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা কবি মো. আরিফ রেজা সারাবাংলাকে বলেন, স্টল সজ্জায় নান্দিক ব্যাপারটা তুলে আনা আমাদের প্রথম চেষ্টা। দ্বিতীয় চেষ্টা বলবো, আমাদের ঐতিহ্যগত ব্যাপারগুলো যেন মানুষ ভুলে না যায়, তার জন্য এমন ডিজাইন বেছে নিয়েছি।
লোকবাংলায় একসময় টিনের ঘর মানে অনেক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবার—এমন ধারণা প্রচলিত ছিল। গ্রামীণ এ ঐতিহ্যকে নিজেদের প্যাভিলিয়নে উঠিয়ে এনেছে ‘আফসার ব্রাদার্স’। এমন থিম বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা রাহাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে থেকেই চিন্তা ছিল এবার ভিন্ন কিছু করবো। কিন্তু ওইভাবে কিছু পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে বিক্রমপুরে একটা বিয়ে খেতে গিয়ে এধরনের বাড়ি দেখে পছন্দ হয়। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত এমন ডিজানে স্টল সাজানোর।’ তিনি জানালেন, অন্যান্যদের মত তারা ফ্লাইউড দিয়ে স্টল নির্মাণ করেননি। বিক্রমপুর থেকে কাঠের তৈরি বাড়িটি তারা কিনে এনে মেলায় প্রতিস্থাপন করেছেন। তাই অন্যান্য স্টলের তুলনায় তাদের খরচও অনেক বেশি পড়েছে বলে দাবি করেন।
দেশের বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্যে ঐতিহ্য তাদের স্টলসজ্জা অতিসাধারণ রাখার চেষ্টা করেছে। হালকা ছাই রঙের মাঝে প্রতিষ্ঠানের লেগো।
আরেক বড় প্রকাশনা পাঞ্জেরী অবশ্য এবার বেশ কার্টুন চরিত্রকে স্টল সজ্জায় ফুটিয়ে তুলেছে।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ার পরেও অনেক স্টলে তার ছবি বড় করে লাগানো থাকতো। এবার একমাত্র কাকলী প্রকাশনীর স্টলে এমনটা দেখা গেল। স্টলের উপরের অংশের চারদিকে তারা হুমায়ুনের ছবি রেখেছেন। নিচে বিভিন্ন লেখকদের ছবি ও তাদের বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যানার ঝুলিয়েছেন।
অক্ষরবৃত্তের স্টলের ওপরের অংশে তারা রেখেছেন বাংলা বর্ণমালা। বামের অংশে লাল রঙে শহীদ মিনার।
সিনেমার পোস্টার কিংবা রিকশা, বাস-ট্রাকের গায়ে রিকশা পেইন্টিং বেশ জনপ্রিয় ছিল একসময়। কালের বিবর্তনে তা বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেটাই তুলে আনার চেষ্টা করেছে ‘কুড়েঘর’। স্টলের ভিতরের অংশ পাখির ডানার মাঝে প্রতিষ্ঠানের লোগো অনেক দূর থেকেও চোখে পড়ে। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম অংশীদার মো. রাকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঠক ও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই মূলত এ থিমটা বেছে নিয়েছি। এছাড়া বলতে পারেন গ্রামীণ ঐতিহ্যকে তুলে ধরাও অন্যতম উদ্দেশ্য।’
শিল্পীর তুলিতে জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে দেখা গিয়েছে জহির রায়হান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদকে। এছাড়া উঠে এসেছে প্রকাশনা শিল্পের নানান বিষয়াদি। পুরো স্টলটি সাজানো হয়েছে সাদা শুভ্র রঙে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একদম শেষ মাথার দিকে ইতি প্রকাশনের স্টল। অফ হোয়াইট রঙের এক তলা একটি বাড়ির থিমে এটি বানানো। এর ম্যানেজার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে অবহেলিত জিয়াউর রহমানের বগুড়ার বাগবাড়িতে অবস্থিত বাড়ির আদলে করা। এ বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি আমাদের প্রকাশক মো. জহির উদ্দিন দীপ্তির ভাবনা থেকে করা।’
জাতীয় সংসদের আদৌলে নিজেদের প্যাভিলয়ন সাজিয়েছে ‘অন্যধারা’। তারা এবারই প্রথম প্যাভিলয়ন বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যেহেতু এর আগে কখনও প্যাভিলয়ন পাইনি, তাই ইচ্ছে ছিল এমনভাবে স্টল সাজাবো যা বইমেলায় আগে কখনও হয়নি। এ ভাবনা আমাদের হুট করে আসেনি, অনেক আগে থেকেই ছিল।’
সারাবাংলা/এজেডএস