ভূস্বর্গে কেন্দ্রের শাসন, সংকট চরমে
২০ জুন ২০১৮ ১৫:২৪
। সন্দীপন বসু ।
ভারতের ভূস্বর্গ জম্মু-কাশ্মির রাজ্য। নামে ভূস্বর্গ হলেও কাশ্মির অনেক দিন থেকেই রাজনৈতিকভাবে যেন এক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এলাকা। একদিকে সেখানে মোতায়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দমননীতিতে রাজ্যের ‘স্বাধীনতাকামী’ জনতার একাংশের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, সহিংস প্রতিবাদ; অন্যদিকে জঙ্গি ও স্বাধীনতাকামীদের প্রতি পাকিস্তানের অব্যাহত উসকানি। সব মিলিয়ে বহুকাল ধরেই রাজ্যটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথার কারণ।
সেই মাথাব্যথা আবারও বেড়েছে গত দুদিনে। এমনিতেই এতোকালের পুষে রাখা ক্ষোভের আগুন, বৈরি জনমত তো ছিলই। আরও নানা সমস্যা এমনিতেই তৈরি হয়ে ছিল। কিন্তু সেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে একমত হতে পারল না পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ও ভারতীয় জনতা দলের (বিজেপি) জোট সরকার। ফলে ভেঙে গেল সাড়ে তিন বছরের জোট, পতন ঘটল মেহবুবা মুফতির নেতৃত্বাধীন সরকারের। আর চলমান সংকট গভীরের আভাস স্পষ্ট হল ভূস্বর্গে।
সংকটের সমাধানে বিজেপির মত ছিল, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে আরো সেনা মোতায়েনের। কিন্তু মেহবুবা মুফতি বারবারই বলে আসছিলেন আলাপ-আলোচনাই উপত্যকায় শান্তি ফেরানোর একমাত্র পথ। এর মধ্যেই রমজান উপলক্ষে জম্মু ও কাশ্মিরে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান বিরতির ঘোষণা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ঈদের পর ওই অস্ত্রবিরতির মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানান গভর্ণর। এ নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন জোটের দুই অংশীদারের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। এরই এক পর্যায়ে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় বিজেপি। আর বিজেপি জোট ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই গতকাল মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে কার্যত পতন ঘটে পিডিপি-বিজেপি জোট সরকারের।
এদিকে জম্মু ও কাশ্মিরে সরকারের পতনের পর আজ বুধবার রাজ্যটিতে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ। রাজ্যপাল এন এন ভোরার ওপর চেপেছে রাজ্যশাসনের দায়ভার। ফলে রাজ্যটিতে ১৯৭৭ সালের পর থেকে এ নিয়ে আটবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি হল।
ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর পিডিপি ২৮ আসন ও বিজেপি ২৫ আসন নিয়ে জোট গঠনের পর থেকেই দুই দলের অন্তর্দন্দ্ব প্রায় প্রকাশ্য ছিল। রাজনৈতিক দূরত্বও ছিল স্পষ্ট। পদত্যাগের পর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির কথায়ই তা উঠে এসেছে বারবার। ক্ষমতা ছাড়ার পর মেহবুবা বলেছেন, ‘কাশ্মীর কোনো শত্রু অঞ্চল নয়। মানুষের মনের ক্ষোভের ক্ষত নিয়াময় করতে চেয়েছিলাম আমরা। চেয়েছিলাম আলোচনায় সমাধান। অথচ কেন্দ্রের মত শক্তি প্রয়োগেই।’ সংবাদমাধ্যমের কাছে মেহেবুবার দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার বারবারই এ অঞ্চলের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে আসছে। অসহযোগিতার কারণেই সাড়ে তিন বছরের সরকার আর দীর্ঘায়িত হল না বলেও মন্তব্য করেছেন মেহেবুবা মুফতি।
সংবাদমাধ্যমের কাছে মেহেবুবা মুফতি আরো জানান, জম্মু কাশ্মীর সরকারে থেকে কোনো ফলদায়ক কিছু করতে পারছিলেন না তিনি। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যটির আইনশৃংখলা পরিস্থিতি পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে বহুকাল ধরেই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিতে হবে তাও ঠিক করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। আর তাই রাজ্য রাজ্যপালের শাসনে চলাই ঠিক হবে বলে মত দেন তিনি।
অপরদিকে রাজ্যের বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা রাম মাধব বলেন, যেখানে পাকিস্তানি জঙ্গিদের হামলায় আমাদের মানুষ মরছে, পুরো রাজ্যের দশা বেহাল সেখানে সরকারে বসে বারবার আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ আর বোধগম্য নয়। অথচ আমরা কাউকে প্রতিহত না করে বারবার আলোচনার নামে সময় অপচয় করছি। এ অবস্থায় কাশ্মিরে পিডিপি সরকারকে আর সমর্থন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রাম মাধব দাবি করেন, গত তিন বছরে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ বেড়েছে কেবল সরকারের নতজানু নীতির কারণে। সরকারের বিরোধিতায় বারবার কমেছে মোতায়েন করা সেনার সংখ্যা, রাজ্যে বেড়েছে সন্ত্রাসবাদের আস্তানা। আরো বেড়েছে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সাধারণ মানুষের সংখ্যাও।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরের সরকারের সিদ্ধান্তে রমজানের সময় সেনা অভিযান বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু সেই সুযোগের অপব্যবহার করে জঙ্গিরা গত মাসেই বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা করে। এতে মোট ১৬জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ঈদের পর থেকেই আবার কাশ্মীরে সেনা অভিযান শুরু হবে। আর নেসই অভিযান শুরু হতেই মতানৈক্যে পতন ঘটল রাজ্য সরকারের।
এদিকে আজ বুধবার সকালে রাজ্যপাল এন এন ভোরা বলেছেন, রাজ্যের এমন এক সংকটময় মূহুর্তে দুইদলের একসঙ্গে থাকা খুব জরুরী ছিল। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের দুর্ভাগ্য যে তা আর সম্ভব হলো না।
ছবি: নিউজক্লিক ও এনডিটিভির সৌজন্যে
সারাবাংলা/ এসবি