প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে বিএনপি
প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা বিজয়ের জন্যই জরুরি
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৫৫ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৩:১৪
ঢাকা: প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা বিজয়ের জন্যই জরুরি— প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে এমন পরামর্শ দিয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠককালে তার হাতে এ চিঠি পৌঁছে দেন তিনি। বৈঠক শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় চিঠির কপি সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় জাতীয় সংসদের মতোই স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই কারচুপি ও অনাচারের আশ্রয় নিয়ে পতিত স্বৈরাচার দলীয় লোকদের বিজয়ী করেছে। এসব ব্যক্তি গোপনে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে, যাতে সরকারের শাস্তি ও উন্নয়ন প্রয়াস ব্যর্থ হয়। অবিলম্বে সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলার মতো ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙ্গে দিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা বিজয়ের জন্যই জরুরি।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘এখন অগ্রাধিৃকার হচ্ছে, নির্বাচনমুখী অতি আবশ্যকীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের একটি দক্ষ, শক্তিশালী ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠা করা। যে নির্বাচিত সরকার সার্বভৌমত্ব অটুট রেখে দেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তা বিধান করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়নের নিশ্চিয়তা দিতে সক্ষম হবে। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একই সাথে চলতে পারে। তাই, আমরা অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বিদ্যমান ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এই দেশ এবং দেশের মানুষের মূল চালিকাশক্তি। এই ঐক্য বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের চর্চাকে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে হবে। আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এবং গণঐক্য বিনষ্ট হয় অথবা ঐক্যে ফাটল ধরে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখতে হবে।’
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর আপনাদের দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পরেও দেশের বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে সরকারের নিয়ন্ত্রণনাধীন অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে পতিত সরকারের অপকর্ম এবং অপশাসনের দোসররা স্বাচ্ছন্দে বিরাজ করছে। এমনকি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও পতিত স্বৈরাচারের কতিপয় দোসর স্থান পেয়েছে। সচিবালয় থেকে শুরু করে সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এসব ব্যক্তিদের একটি কুচক্রিমহল ‘যোগ্য ও অভিজ্ঞ’ বলে বহাল রাখার অপচেষ্টায়রত। অথচ এসব তথা কথিত যোগ্য ও অভিজ্ঞদের যোগ্যতা ছিল ফ্যাসিবাদের তোষণ করা ও নির্বিবাদে অন্যায় আদেশ পালন করা।’
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘যথাশিগগির এদের অপসারণ করা না হলে নিজ স্বার্থেই এরা পতিত ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন ও পুর্নবাসনে সহযোগিতা করে দীর্ঘ ১৬ বছর এবং বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের শহিদদের আত্মদানকে ব্যর্থ করে দেবে। অতিসম্প্রতি বিগত ফ্যাসিবাদের সময় পদোন্নতি বঞ্চিত ও অকাল অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদে পদায়ন করা যেতে পারে।’
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিতর্কিত ও স্বৈচারের দোসরদের অনেককে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকায় স্বৈরাচারের দোসর এসব ডিসি আওয়ামী দোসরদের গোপনে অনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা কিছুই নিয়ন্ত্রণে আসছে না।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের রাতের ভোট, ভোটারবিহীন ভোট, ডামি ভোট অনুষ্ঠানকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টো তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা এখনো তাদের সাবেক প্রভুদের ইশরায়-ইঙ্গিতে কাজ করে যাচ্ছে।’
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছে মর্মে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করার নানা প্রকার লক্ষণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে, যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখকর নয়। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো দলের আত্মপ্রকাশকে আমরা স্বাগত জানাব।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে যুক্ত দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরচার যে সব মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানী করেছে তা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ বিধায় ক্ষতি ও হয়রানির শিকার নিরপরাধ মানুষদের আশ্বস্ত করার জন্য আমরা সরকারকে সকল মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে মর্মে একটা ঘোষণা দেয়াওর আহ্বান জানাচ্ছি।’
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অধস্তন আদালতে গায়েবি মামলায় রাতের বেলায় কোর্ট বসিয়ে যে সমস্ত বিচারক বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের অন্যায়ভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সাজা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের বিচার ব্যবস্থায় বহাল রেখে স্বাধীন বিচার বিভাগ বাস্তবায়ন করা জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অস্বাভাবিক দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি রোধ, দ্রুত নির্বাচনি রোড ম্যাপ দেওয়া, প্রশাসনের সর্বস্তরে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর মুক্তকরণের অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে তাকে এবং তার সরকারের প্রতি পুনর্সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম