বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসে অচলাবস্থা
লাইটারেজ জাহাজগুলো এখন ‘ভাসমান গুদাম’
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: লাইটারেজ জাহাজের সংকটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেল (বড় আকারের জাহাজ) থেকে পণ্য খালাসে আংশিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। নৌ পরিবহন অধিদফতর বলছে, অনেক লাইটারেজ জাহাজ আমদানি পণ্য নিয়ে সাগরে ও নদীতে ভাসছে, কিন্তু আমদানিকারক পণ্যগুলো খালাস করছে না। কিছু আমদানিকারক লাইটারেজ জাহাগুলোকে ‘ভাসমান গুদাম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফলে এ সংকট তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় নৌ-পরিবহণ অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পণ্য খালাস না করে ভাসমান লাইটারেজ জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে সমুদ্রপথে দেশি-বিদেশি মাদার ভ্যাসেল প্রথমে আসে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে। এর মধ্যে গভীরতা বেশি হওয়ায় যেসব মাদার ভ্যাসেল সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারে না, সেগুলোর পণ্য বহির্নোঙ্গরেই লাইটারেজ জাহাজের (ছোট আকারের জাহাজ) মাধ্যমে খালাস করা হয়। এরপর সেসব পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটে ও বন্দরের জেটিতে এনে খালাস করা হয়। আবার লাইটারের জাহাজের মাধ্যমে নৌপথে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যেও পণ্য পরিবহণ করা হয়।
সূত্রমতে, চট্টগ্রামে প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস ও পরিবহণ করা হয়। এর সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি)। তারাই প্রতিদিন বার্থিং সভা করে মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়।
কিন্তু গত দু’সপ্তাহ ধরে বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে পর্যাপ্ত লাইটারেজ জাহাজের বরাদ্দ দিতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসে কার্যত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। গত দু’দিনে ১৩টি মাদার ভ্যাসেলের জন্য কোনো লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ৪৫টি মাদার ভ্যাসেল পণ্য নিয়ে অবস্থান করছিল। পর্যাপ্ত লাইটারেজ জাহাজ না পাওয়ায় বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের জট তৈরি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ মাদার ভ্যাসেলগুলোতে গম, ডাল, সরিষা, লবণ, সয়াবিন ভূষি, রড, এইচ আর কয়েল, কয়লা, স্ল্যাগ, পাথর, বিভিন্ন ধরনের সারসহ আরও নানা আমদানি পণ্য আছে। লাইটারেজ জাহাজের অভাবে মাদার ভ্যাসেলগুলো অপেক্ষমাণ থাকায় এর গড় অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি জাহাজের পরিচালন ব্যয় বাবদ দৈনিক ১৫ হাজার মার্কিন ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশি জাহাজগুলোর এদেশিয় প্রতিনিধিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদিও বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের অপেক্ষমাণ থাকার বিষয়টির সঙ্গে বন্দরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তারপরও বিষয়টি আমাদের এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। যারা লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেন, যারা সেগুলো ভাড়া নেন, সবার কাছে প্রত্যাশা, পরিস্থিতির যাতে দ্রুত উন্নতি হয়। মাদার ভ্যাসেলগুলো যাতে দ্রুত পণ্য খালাস করে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরত যেতে পারে। অন্যথায় আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’
অভিযোগ আছে, সাগরে ও নদীতে যেসব লাইটারেজ জাহাজ ভাসছে, সেগুলোর অধিকাংশই ভোগ্যপণ্য বোঝাই, যেগুলো রমজানকে সামনে রেখে আমদানি করা হয়েছে। এই মুহূর্তে সেসব পণ্য বাজারে গেলে দাম নিম্নমুখী হয়ে যাবে, এ আশঙ্কা থেকে আমদানিকারকরা সেসব পণ্য খালাস না করে লাইারেজ জাহাজে রেখে দিয়েছেন।
লাইটারেজ জাহাজের বিদ্যমান সংকট নিয়ে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ঢাকায় নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলমের সভাপতিত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাহাজ মালিকদের সংগঠন, শিপিং এজেন্ট, চট্টগ্রাম বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
কমডোর মাকসুদ আলম বলেন, ‘আমরা বিদ্যমান সংকটের কারণ ও এর সমাধানে পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। সংকটের মূল কারণ হচ্ছে অনেক ইম্পোর্টার লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করেছেন, কিন্তু সেই পণ্য নিজস্ব এরিয়ায় খালাস না করে লাইটারেজ জাহাজগুলোকে ফ্লোটিং অয়্যারহাউজ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ইম্পোর্টারদের প্রতি আমাদের আহ্বান, তারা যেন লাইটারেজ জাহাজগুলোকে খালি করে দেন এবং আউটার অ্যাংকারেজে লাইটারেজ জাহাজের পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করেন।’
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘যেসব ইম্পোর্টার এক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড এবং নৌ পুলিশের সমন্বয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। আমি আশা করব, সবাই পণ্য খালাস এবং পরিবহনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
অচলাবস্থা পণ্য খালাস বহির্নোঙ্গর ভাসমান গুদাম লাইটারেজ জাহাজ