ভাঙা ট্রলিই সচল রেখেছে বেলালের জীবন
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৩ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৯
ঢাকা: রোগী টানার ভাঙা ট্রলি (হুইল চেয়ার)। সেই ট্রলিতে বসে মেঝেতে পা ঠেলে চলছে ১০ বছরের প্রতিবন্ধী শিশু বেলাল। শিশুটির মা ফাহিমা হাসপাতালে ট্রলি দিয়ে রোগী টানেন। সবসময় মায়ের সঙ্গেই থাকে প্রতিবন্ধী বেলাল। হাসপাতালে ফ্লোরে কখনো ট্রলির চাকা আটকে গেলেও অন্যের সহায়তা নিতে অপারগতা রয়েছে তার। আর এদিকে ট্রলি টেনে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলছে না ফাহিমার। ফলে ছেলেকে নতুন ট্রলিও কিনে দিতে পারছেন না। ফলে কষ্ট করে বেড়ে উঠছে শিশুটিও। নতুন একটি ট্রলি পেলে বেলালের চলতে-ফিরতে কষ্ট কমবে, এমনটি জানিয়েছেন তার মা। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সম্প্রতি এক রাতে দেখা হয় প্রতিবন্ধী শিশু বেলাল ও তার মা ফাহিমার সঙ্গে।
রাত ১০ টার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায় শিশু বেলাল ট্রলিতে বসে পায়ে পায়ে ঠেলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। সেখানে দুই ভবনের মেঝেতে কিছুটা উঁচু-নিচু থাকায় পা দিয়ে ট্রলি ঠেলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। এই প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে ট্রলি ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় বেলাল। অস্পষ্ট কণ্ঠে জানায়, সে-ই পারবে। তখন শিশুটিকে অনুসরণ করতে থাকেন প্রতিবেদক। কিছুক্ষণ পর সেখানেই দেখা মেলে তার মা ফাহিমার সঙ্গে। ফাহিমা অন্য একটি ট্রলিতে করে হাসপাতালের ছয় তলায় রোগী নিয়ে যাচ্ছিলেন। রোগী ঠেলতে ঠেলতেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন বেলালের মা ফাহিমা।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বেলালের বয়স এখন ১০ বছর। আমি ১০ বছর ধরেই এই কাজ করছি। স্বামী ছেড়ে গেছে, বিয়ে করেছে। ট্রলি ঠেলে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই কোনোরকমে সংসার চলছে। থাকি আগারগাঁও বস্তিতে। তবে বেশিরভাগ সময় হাসপাতালেই থাকা হয়। ট্রলি টানার পুরোটা সময় বেলাল আমার সঙ্গেই থাকে। হাসপাতালেই থাকে।’
ফাহিমা আরও বলেন, ‘অনেক চাকরি খুঁজছি, পাই না। ওর জন্মের পর থেকেই এই কাজ করছি। আমার ছেলে বেলাল শারিরিক প্রতিবন্ধী, হাঁটতে পারে না। তাই ওকে সঙ্গে নিয়েই ট্রলি টানি। সমাজসেবা থেকে ট্রলি দিয়েছিল। একটা চুরি হয়ে গেছে। ভাঙা ট্রলিটা এখন ঠিক করে বেলালকে বসিয়ে রেখে ওর মোটামুটি ভালো ট্রলি দিয়ে রোগী টানি। এতে আমার সংসার চলে না। কাল কামাই করেছি ৩০০ টাকা, আজও ৩০০। মাঝে-মধ্যে ডাক্তারদের কাজ করি, তারাও দেয় কিছু। এসব দিয়েই কোনোরকমে খাবার কিনি। এভাবেই টুকটাক করে সংসার চলে।’
বেলালের মা বলেন, ‘একটা হুইল চেয়ার খুব জরুরি। তাহলে ভালোটা দিয়ে রোগী টানতে পারব। আর এই চেয়ারটা ছেলের জন্যই থাকবে। এতে তার কষ্ট কম হবে। চেয়ারতো তিনটা চুরি হয়ে গেছে। তাই কষ্ট বেড়েছে।’
কথপোকথনে জানা যায়, সমাজসেবা থেকে ভাতা পেতেন ফাহিমা। তবে মোবাইল হারানো ও পিনকোড ভুলে যাওয়ায় এখন কোনো ভাতা পান না। তিনি বলেন, ‘পিন কোড ভুলে গিয়েছিলাম। তখন আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে পিন কোড ঠিক করে দিছে। দেওয়ার পর মোবাইলটা গত রোজার ঈদে চুরি হয়ে গেছে। তার পর থেকে আমি আর কোনো ভাতা পাইনি। অফিসে গেলে স্যারে আমাকে বকা দেয়- আপনি পারেন না সিম ধরে রাখতে, পারেন না পিন ধরে রাখতে। এখন আর আমি ভাতা টাতা কিছু পাই না। যদি পারেন ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আর একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেন।’
ছয় তলা থেকে নিচে নামার পথে লিফটের সামনে আবারও দেখা হয় বেলালের সঙ্গে। সারাবাংলাকে বেলাল জানায়, মা ছয়তলায় গেছেন। রোগী ভর্তি করাতে। সে তার মায়ের সঙ্গে সবসময় থাকে। তাই এই জায়গায় মায়ের অপেক্ষায়…।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম