‘৫ আগস্টের পর তরা বহুত বাইড়্যা গেছস’
৬ সমন্বয়ককে তুলে আনা সেই ইকবালই পেটায় ১৪ শিক্ষার্থীকে
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৫৮ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০৭
ঢাকা: মো. জাভেদ ইকবাল। বাড়ি খুলনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে করতেন ছাত্রলীগ। ৩৫তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। প্রথমে ছিলেন রমনা জোনে। এর পর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) যুক্ত হন। জুলাই আন্দোলনের সময় ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাভেদ ইকবালকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়।
তার গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকজন ভিকটিম অভিযোগ করে বলেন, যেখানেই গণজমায়েত ছিল সেখানেই তার অবস্থান লক্ষ্য করা যেত পেটোয়া বাহিনীর কর্তার ভূমিকায়। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ছিল। সেই সমাবেশে রাজধানীর আরামবাগ এলাকায় বেধরক পিটিয়েছেন এই জাভেদ ইকবাল। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষকেও পেটাতে দেখা গেছে জাভেদকে।
৫ আগস্টের আগে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ ছয় সমন্বয়ককে ডিবিতে তুলে নিয়ে যাওয়ার খলনায়ক ছিলেন এই জাভেদ ইকবাল। অভিযোগ রয়েছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যায় সরব ছিলেন এই জাভেদ ইকবাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জানান, জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের সময় রাজধানীর উত্তরা এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
৫ আগস্টের পর জাভেদ ইকবালকে গোয়েন্দা থেকে সরিয়ে র্যাব-২-এ বদলি করা হয়। সেখানেও থেমে ছিলেন না বেপরোয়া জাভেদ। গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালাল চক্রের সদস্যদের হাতেনাতে ধরায় ১৪ শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে বেধরক মারধর করে আহত করেন র্যাব-২ এই কর্মকর্তা তৎকালীন এএসপি জাভেদ ইকবাল। এ সময় শিক্ষার্থীদের নাকি মারধর করতে করতে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর তোরা বহু বাইড়া গেছস। তোদের সাইজ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সম্প্রতি জাভেদ ইকবালকে গ্রেফতারের পর খবরে ছবি প্রকাশ হওয়ায় মারধরের শিকার ওই শিক্ষার্থীরা তাকে দেখে চিনে ফেলে। এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা যায়, গত ২৭ জানুয়ারি (সোমবার) সকালে বসিলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ২ শিক্ষার্থী পাসপোর্ট করতে যায়। সেখানে যাওয়ার পর পাসপোর্ট অফিসের পাশের বাড়ির নিচে কম্পিউটার দোকানের মালিক নূরে আলম শিক্ষার্থীদের পাসপোর্টের যাবতীয় কাজ করে দেওয়ার আশ্বাসে দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তিনি শিক্ষার্থীদের পাসপোর্টের সমস্যা শুনে পাসপোট অফিসের এক অফিসারকে ফোন করেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা দালাল চক্রের সদস্য বুঝতে পেরে দালাল ধরতে তারা কিছু নকল কাগজপত্র দিয়ে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট করাতে দেন। দালালের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে কথোপকথনের সকল কিছু কৌশলে শিক্ষার্থীরা ভিডিও করে রাখেন। দোকানের মালিক দালাল চক্রের সদস্য নূরে আলম যখন তাদের পাসপোর্ট অফিসের তৃতীয় তলায় এক অফিসারের রুমে নিয়ে পাসপোর্টের সব কাজ শেষ করে। তখন শিক্ষার্থীরা পাসপোর্ট অফিসের লোকজনকে বিষয়টা জানালে তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।
এক পর্যায়ে পাসপোর্ট অফিস থেকে র্যাবের কর্মকর্তাদের ফোন করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠীদের ফোন ও ম্যাসেজে বিষয়টি জানালে বেশ কয়েকজন পাসপোর্ট অফিসে তাদের উদ্ধার করতে চলে আসে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ঘটনাটি মোহাম্মদপুর থানাকে জানানোর পরও থানা থেকে শিক্ষার্থীদের কোনো সহায়তা করা হয়নি। পাসপোর্ট অফিস থেকে ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিভিল ও পোশাকে র্যাবের বেশ কয়েকজন সদস্য এসে শিক্ষার্থীদের টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায়। এ সময় যেসব শিক্ষার্থী তাদের সহপাঠীদের উদ্ধার করতে এসেছিলেন তাদেরকেও র্যাব গাড়িতে তুলে র্যাব-২ এর অফিসে নিয়ে নির্যাতন করে। শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর জাভেদ ইকবাল প্রথমে তার রুমে নিয়ে শিক্ষার্থীদের বেধরক মারধর করে। এরপর শিক্ষার্থীদের একজনকে র্যাব-২ এর সিইও’র রুমে নিয়ে মোবাইল কেড়ে নেয়।
তুলে নিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একজন তাসির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কয়েকদিন ধরে মোহাম্মদপুরের বসিলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নানা অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের খবর পাচ্ছিলাম। আমরা নিজেরাই পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখি ভুয়া কাগজপত্র দিলে দালাল চক্র আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনায়াসে পাসপোর্টের কাজ সম্পন্ন করে ফেলে। আমরা সেটা পরীক্ষা করার জন্য পাসপোর্টের আবেদনে কিছু নকল কাগজপত্র দিই। কিন্তু তারা সেগুলো কোনো যাচাই-বাচাই ছাড়াই অনলাইন থেকে শুরু করে সবকিছু ওকে করে দেয়। আমরা এসব ডকুমেন্টস আমাদের মোবাইল ফোনে প্রমাণ হিসেবে ভিডিও করে রাখি।’
তিনি বলেন, ‘এর পর আমরা পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তার কাছে ডকুমেন্টসগুলো নিয়ে যাই। তখন তিনি আমাদের টাকা-পয়সা দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করতে চায়। কিন্তু আমরা কোনো টাকা-পয়সা না নেওয়ায় নানারকম হুমকি দেয়। যখন আমরা খেয়াল করলাম, বিষয়টি দালাল চক্রের সদস্যরা অন্যদিকে নেওয়া চেষ্টা করছে, তখনই মোহাম্মদপুর থানার তদন্ত অফিসারকে ফোন দিই। এর পর তিনি আমাদের একটা নাম্বার দিয়ে ওই নাম্বারে যোগাযোগ করতে বলে। আমরা ওই নাম্বারে যোগাযোগ করতে করতেই ঘটনাস্থলে অস্ত্র-শস্ত্রসহ সিভিলে এবং পোশাকে র্যাবের বেশ কয়েক লোক এসে আমাদের টেনে হেঁছড়ে তাদের বসিলা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়। এ সময় আমাদের আটকের খবর শুনে আমাদের অন্য সহপাঠীরা এলে র্যাব তাদেরও আটক করে।’
তাসির বলতে থাকেন, ‘আটকের পর র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমার মোবাইল ফোন নিয়ে হোয়াসটঅ্যাপ, মেসেঞ্জার এবং কল লিস্ট চেক করতে করতে আমাকে গালি দিতে থাকে। আর জিজ্ঞেস করে, তোদের মধ্যে সুমন কে? সুমনকে কই পাওয়া যাবে? এ কথা বলে আমাদের প্রচণ্ড রকম মানসিক ও অমানবিক টর্চার করে কয়েকজনকে মারধর করে। এর পর আমাদের ১৪ জনকে তাদের গাড়িতে তুলে সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর থানায় দিয়ে যায়। আমাদের আটকের পর র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলে, পাসপোর্ট অফিসে কী হয় না হয় তাতে তোদের সমস্যা কি? আর এরা ৫০০/১০০০ হাজার টাকা নিলে তোদের সমস্যা কি? তোরা ৫ আগস্টের পর থেকে প্রচুর জ্বালাইতেছস। এখন তোদের সব সোজা করে ফেলব। এমন কথা বলে আমাদের সবার ছবি তুলে ঠিকানা লিখে রাখে।’
আরেক শিক্ষার্থী শাকিল সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘র্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের প্রচণ্ড মারধর করে। মারধরের শিকার হয়ে আমার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আমাদের মারধর করে বলে, মারধরের কোনো খবর বাইরের কাউকে বললে কিংবা আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা কাউকে জানালে যেকোনো মামলায় তুলে নিয়ে বড়ধরনের ক্ষতি করবে। আমাদের সব ডকুমেন্টস তাদের কাছে আছে। আমরা বিষয়টি যদি কোন মিডিয়া কিংবা কাউকে শেয়ার করি তাহলে আমাদের বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। আমরা চাইলেও বাঁচতে পারব না।’
এ ছাড়াও, আহিল রহমান শুভ নামে আরেক শিক্ষার্থীকেও মারধর করে আহত করা হয়। তাসির, শাকিল ও শুভদের মতো এমন ১৪ জন শিক্ষার্থী বলেন, সেদিন আমাদের তুলে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। আমরা ওইদিন শুধু র্যাবের ওই অফিসারের চেহারা চিনতাম, নাম জানতাম না। গতকাল যখন খবরে ওই অফিসারের চেহারা দেখলাম, তখন তার নাম জানতে পারলাম। তার প্রতিটি হুমকিতে মনে হয়েছে, সে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ডরকম ক্ষেপে আছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরূপী খুনি জাভেদ ইকবালের বিচার চাই।’
এসব বিষয়ে জানতে র্যাব-২ এর অধিনায়ক (সিইও) খালিদুল হক হাওলাদারকে ফোন করা হলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে কল করতে বলেন। এর পর হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি নিয়ে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখা থেকে বক্তব্য নেবেন। এর পর তিনি ফোন কেটে দেন।’ তখন মিডিয়া শাখায় যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি তারা জানেন না বলে জানানো হয়।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম