ভালোবাসা ছড়িয়ে গেল সবখানে
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:১০
“ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী/ ভালোবাসা হল নিশ্বাস এ দেহের/ নিশ্বাস বীনা মানুষ কখনো বাঁচে কী/ ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী/ যেভাবেই হোক তাই ভালোবাসা পেতে চাই/ তার এত টুকু কণা আছে গো তোমার কাছে কী/এ যে গো হীরের হার একবার মেলে যার/কভু হীরার অভাব মেটে তার ভাঙা কাচে কী/ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?’’— এই গানের স্রষ্টা গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করে ভালোবাসা বোঝার এবং উপলব্ধি করার ক্ষমতা বোধ করি সবারই আছে। কেবল প্রকাশ ভঙ্গির বেলায় একেকজন একেকরকম।
বয়স, সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ভালোবাসার প্রকাশ কখনো শৃঙ্গার (আদি), কখনো বীর, কখনো করুণ, কখনো অদ্ভুত, কখনো হাস্য, কখনো রৌদ্র, কখনো শান্ত, কখনো স্থুল, কখনো সুক্ষ্ণ, কখনো বাৎসল্য, কখনোবা মধুর রসে সিক্ত হয়ে থাকে।
এই যেমন প্রতিবছর অমর একুশে বই মেলার চৌদ্দতম দিনে ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস যখন যুগলবন্দি হয়ে ধরা দেয়, তখন ভালোবাসার কাঙ্গালপনায় কেউ কেউ শান্ত, সুক্ষ্ণ ও মধুর রসের স্তর অতিক্রম করে শৃঙ্গার (আদি রসত্মক) স্তরে উপনীত হয়। লাজ-লজ্জা, কুল-কলঙ্কের ভয় তখন কাজ করে না। পরম প্রিয় মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখার উদগ্র বাসনা পেয়ে বসে কম-বেশি সবাইকে। কাম-গন্ধহীন প্লেটনিক প্রেমও তখন শরীর ও মনকে নাড়া দিতে থাকে।

এরকম লোকে লোকারণ্য বইমেলার আবহ গুটিকয়েক দিনেই দেখা যায়। তার মধ্যে একটি ছিল আজ। ছবি: সারাবাংলা
বইমেলার ১৪তম দিন শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩ টা ৫৯ মিনিট। বাংলা একাডেমির ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ভবনসংলগ্ন পুকুরের সিঁড়িতে পাম্প গাছের টবের ‘এতটুকু’ আড়ালে বাসন্তি রঙের শাড়ি পরা এক তরুণীকে বারবার ছুঁয়ে দেখছিল তার ‘শখের’ তরুণ। বাধাহীন এই ছুঁয়ে দেখার অধিকার অর্জন করতে কতদিন লেগেছে, সেটা বলা মুশকিল। তবে ভালোবাসা দিবসে বইমেলার প্রাঙ্গণে সময় কাটাতে আসা তরুণ-তরুণীদের এ ধরনের প্রেম বিনিময় একেবারই স্বাভাবিক। সীমালঙ্ঘন না করলে কেউ কিছু বলতে আসে না।
যেহেতু ফাগুনের আগুন লাগা প্রথম বিকেল, সঙ্গে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তাই এ ধরনের দৃশ্যের অবতারণা মেলা জুড়েই চোখে পড়বে— এটা ধরে নিয়েই বইমেলায় প্রবেশ। লাল, হলুদ, সাদা, বাসন্তী এবং হাল্কা সবুজ রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে তরুণ-তরুণীরা বইমেলায় এসে মেলার আবেদন বাড়ানোর পাশাপাশি বই বিক্রির বন্ধ্যাত্বকে ঘুচিয়ে দেবে— এমন আশা বরাবরই করে থাকেন বইমেলার আয়োজক, বইয়ের প্রকাশ এবং লেখকরা। কিন্তু, কী এক অজানা কারণে যেন, দিন দিন এ আশার গুড়ে বালি পরে চর জমে যাচ্ছে।

আজ ভালোবাসা দিবসের পাশাপাশি ছিল পহেলা ফাল্গুনও। সেই ফাগুনের আবহ ছড়িয়েছে বইমেলায়। ছবি: সারাবাংলা
নানা বয়সের, নানা পোশাকের ললনারা প্রিয়জন অথবা বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে মেলায় ঢোকার আগে গোলাপ-গাদা-জিপসি ফুলের অলঙ্কারে নিজেকে যেভাবে সাজিয়েছেন, সেভাবে নিজের অন্তর বা মনোজগৎ সাজানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হল না। সাজ-গোজে বদলে যাওয়া নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করতে যতটা আগ্রহী, জ্ঞানের জগতে নিজেকে বন্দি করতে ততটা আগ্রহী তারা নন। এর প্রভাব বইমেলার স্টলে-স্টলে, প্যাভিলিয়নে-প্যাভিলিয়নে। মেলায় প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও স্টল-প্যাভিলিয়নগুলো বলতে গেলে ফাঁকা। আবার স্টল-প্যাভিলয়নে ভিড় থাকলেও মেলায় আগতদের হাত দু’টি শূন্য।
বিকেল পৌনে ৫ টার দিকে ‘নয়নজুলি’ প্রকাশনীর দৃষ্টিনন্দন স্টলে চোখ আটকে গেল। বিষয়টি এমন নয় যে, ‘নয়নজুলি’র অঙ্গ-সজ্জা দৃষ্টি হরণ করেছে, বরং সেখানে সেলফি তুলতে ব্যস্ত দুই তরুণীর অপরূপ সৌন্দর্যে বাঁধা পড়ে গেছে নয়ন যুগল। ছবি তোলা শেষ, তরুণী দু’টির প্রস্থান। ‘নয়নজুলি’র বিক্রয় কর্মীও একজন চাকমা তরুণী। অতঃপর তার সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু।
বই বিক্রি কেমন হচ্ছে? লিলি চাকমা স্মিত হেসে বললেন, ‘ভালো তো বলার সুযোগ নেই। আবার খারাপও বলতে চাই না। এই হচ্ছে মোটামুটি।’
আজ তো বিশেষ দিন! অন্যদিনের থেকে বই বিক্রি একটু বেড়েছে না? লিলি চাকমার সরাসরি উত্তর— ‘মোটেই না। লোকজন আসে, ছবি তোলে, চলে যায়।’ ‘লোকজন আসে, ছবি তোলে, চলে যায়’— এই কথার মধ্যে পুরো বইমেলার বাস্তব চিত্র আঁকা আছে। মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ার পর মানুষের হাতে বই নয়, ফোনই বেশি দেখা যায়। মেলায় আসে, মোবাইলে ছবি তোলে অথবা স্ক্রল করতে করতে সময় পার করে দেয়।

আশানুরূপ বিক্রি না হলেও ভালোবাসার হাসি ছড়িয়ে আছে বিক্রিয়কর্মীর মুখে। ছবি: সারাবাংলা
‘নয়নজুলি’র প্রকাশক ড. কামাল আলী খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো মেলায় স্টল দিয়েছি। গতবছর প্রথম ১৪ দিন যা বিক্রি হয়েছিল, এবার তার অর্ধেকও হয়নি। বাকি ১৪ দিনে হয়তো বিক্রি বাড়বে। তবে, বিক্রি হোক বা না হোক, মানুষ বইমেলায় আসুক। মানুষ না এলে তো মেলাই হবে না।’
অন্যবারের চেয়ে এবারের মেলায় মাদরাসা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ভিড় একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র স্টলও দিয়েছে তারা। এসব স্টলে অপেক্ষাকৃত বেচাবিক্রি একটু ভালো। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারাই বইমেলায় আসছেন, তারাই কিছু না কিছু বই কিনে নিয়ে ঘরে ফিরছেন।
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা হয় মোহম্মদপুর থেকে আসা ‘মাদরাসাতুস সাহাবা’র শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বির সঙ্গে। হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বির কাছে জানতে চাওয়া হলো— আজ একটা বিশেষ দিবস আছে, সেটা কী? জবাবে তিনি বললেন ‘শবে বরাত’! অন্য কোনো দিবসের খবর জানেন না? ‘না, অন্য কোনো দিবসের খবর আমরা জানি না।’ তার সঙ্গে থাকা আরেক শিক্ষার্থী বললেন, ‘আজ ভ্যালেন্টাইস ডে’।
মূলত, ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে ফজলে রাব্বিরা ভালো করেই জানেন। কিন্তু, বলতে চান না কিছু। যে সংস্কৃতির ভেতরে তাদের বেড়ে ওঠা, সেখানে ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে অনেক বেশি জানার পরও বিন্দুমাত্র প্রকাশের সুযোগ নেই। অবশ্য দিন দিন পড়া-লেখা ও জানা-শোনার পরিসরটা বাড়ছে বৈকি! যেমন ফজলে রাব্বি কোনো ধর্মীয় বই না কিনে লতিফুল ইসলাম শিবলী অনূদিত বিদেশি ভাষার কিশোর উপন্যাস ‘ফ্রন্টলাইন’ ও ‘দখল’ বই দু’টি কিনেছেন। এই সিরিজের আগের বইগুলোও তিনি পড়েছেন।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম