‘ইন্টারনেট সহজলভ্য করতে এই খাত থেকে রাজস্ব আহরণ কমাতে হবে’
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:১৯ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৫১
ঢাকা: দেশে ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনতে সেবাদাতাদের স্তর (লেয়ার) কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করতে চাইলে সরকারকে এই খাত থেকে রাজস্ব আহরণ আরও কমাতে হবে। সেইসঙ্গে বিটিআরসি যাতে স্বাধীন কমিশন হিসেবে সঠিক ও নিরপেক্ষ কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিটিআরসিতে যাতে আর কখনোই রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে নিয়োগ দেওয়া না হয় নিশ্চিত সেটাও করতে হবে।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা খাতে সংস্কার এর প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে খাতসংশ্লিষ্টরা বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেন, ‘দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। আইসিটি সেক্টরে হওয়া দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সহজলভ্য করে দিতে হবে। সেরকম পলিসি ঠিক করতে হবে রাজনীতিবিদদের।’ বিটিআরসির প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা নিয়েও কড়া সমালোচনা করেন ইশরাক।
আরও পড়ুন: টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে: ইশরাক
মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি লাইসেন্স দেওয়া হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেন দেশে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মোবাইল অপারেটররা ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় আসতে চাচ্ছে। আমরা শুনেছি, একটি অপারেটর আইএসপি লাইসেন্সের জন্যে আবেদন করেছে। এটি কোনোভাবেই দেওয়া উচিত হবে না। আমরা আইএসপি অপারেটররা তা মেনে নেব না। আমরা চাইব না এই লেয়ারে তারা ব্যবসা করুক। তাহলে আমাদের ব্যবসাই থাকবে না। বরং বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আইএসপি এমভিএনও হয়ে মোবাইল সার্ভিস দেয়। সরকার এটি নিয়ে ভাবতে পারে।’
আরও পড়ুন: ‘মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি লাইসেন্স দিলে মেনে নেব না’
টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসিতে রাজনৈতিক নিয়োগে ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিটিআরসিতে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করা উচিত এবং যারা বিটিআরসিতে চাকরি করবেন তাদের সবক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকা উচিত বলেও অভিমত প্রকাশ করেন- আইটি ব্যবাসায়ী ও আইএসপিএবি’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক।
আইটি খাতে রাজত্ব করা সামিট গ্রুপকে ইঙ্গিত করে বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘গত ১৫ বছরে এ খাতে অনেকেই ব্যবসা করতে আসেনি, লুটপাট করতে এসেছে। এখনও এনটিটিএন মাত্র দুটি। দেশে লুটপাটের তৃতীয় খাত ছিল টেলিকমিউনিকেশন খাত। এ খাতের আদানি বা এসআলম কারা তাদের সম্পর্কে আমাদের বলা উচিত। আপনারা হয়তো বুঝে গেছেন তারা কারা। তাদের প্রতিনিধি এই পোগ্রামেও আছেন।’
তিনি বলেন, ‘গ্রাম পর্যায়ে এখনও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা সেভাবে পৌঁছায়নি। সরকার ইন্টারনেট ব্যবসায় বিভিন্ন লেয়ার তৈরি করে রেখেছে। এই লেয়ার, ওই লেয়ার করে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বিটিআরসিকে এনবিআরের বি টিম হিসাবে আবিষ্কার করেছে। দেশে ইন্টারনেটের দাম ততদিন কমবে না যতদিন সত্যিকার অর্থে সরকার ইন্টারনেটের দাম কমাতে না চাইবে। কারণ, দাম কমালে তো সরকার টাকা (রাজস্ব) পাবে না। ৬০ শতাংশ কর নিয়ে যাচ্ছে। দাম তো এমনিতেই বেড়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে স্টারলিংকের ইলন মাস্কের কথোপকথনের তথ্য তুলে ধরে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘সাম্প্রতিক এই উদ্যোগকে আমাদের সাধুবাদ জানাতে হবে। স্টারলিংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। ভূ-রাজনীতির বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’
ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইআইজিএবি) এর সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ‘টেলিকমিউনিকেশন খাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। স্টার লিংককে নিয়ে আসার উদ্যোগকে আমরাও স্বাগত জানাই। তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদেরও যেন স্পেস দেওয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে দেশীয় ছোট উদ্যোক্তাদের যেন গলা টিপে না ধরা হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিটিআরসিকে এনবিআরের কালেক্টর (রাজস্ব সংগ্রহকারী) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গতবছর বিটিআরসির রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার কোটি টাকা। এ বছর আরও ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইন্টারনেটের দাম আরও একটু কমিয়ে আনতে চাই। তবে, সেই ফাইলও আটকে গেছে বিটিআরসিতে।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোন স্বার্থে, কী স্বার্থে একজন রিটায়ার্ড লোককে বিটিআরসিতে নিয়োগ দেওয়া হলো। বিটিআরসি এখন একটি অথর্ব কমিশনে পরিণত হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, কাউকে কাউকে খুশি করার জন্য তাদের আত্মীয় স্বজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই, অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো বিটিআরসির রিফর্ম হোক।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা খাতে সেবা প্রদানের বিভিন্ন স্তরের সার্ভিস অর্থাৎ লেয়ার তিন স্তরে নামিয়ে আনা দরকার। যেমন আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি, এ ধরনের লেয়ারের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো প্রয়োজন নেই। এসব লেয়ার কমিয়ে আনলে সেবার মান বাড়ার পাশাপাশি দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টেলিকম বিশেষজ্ঞ মুস্তাফা মাহমুদ হুসাইন। এতে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালেদ আবু নাসের, রবি’র সিনিয়র ডিরেক্টর অনামিকা ভক্ত, গ্রামীণফোনের হোসেন সাদাত, এমটব’র হেড অব কমিউনিকেশন আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম