ইতালি না নিয়ে লিবিয়ায় পাচার
৭১ লাখ টাকা দিয়েও মুক্তি মিলছে না ২ যুবকের
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:২৯
পাচারের শিকার ভুক্তভোগী রিপন শিকদার ও মাছুম মোল্লা বামে, ডানে দালাল চক্রের প্রধান মোজাম্মেল। ছবি: সারাবাংলা
ঢাকা: সাদেক শিকদার। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নে। পূর্ব পরিচিত আহাদ মোল্লা ও নজরুল হালদারের মাধ্যমে ছেলে রিপন শিকদারকে (২৮) ইতালি পাঠানোর জন্য ঢাকায় আসেন। ঢাকার শাহজাদপুরে হাওলাদার ট্রাভেলসে এসে মোজাম্মেল হোসেন নামে এক দালালের সঙ্গে তার কথা হয়। মোজাম্মেল তাকে জানান, তারা জেনুইনভাবে ইতালিতে লোক পাঠান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য তাদের দাবি করা ১৫ লাখ টাকা দেন। এক পর্যায়ে ছেলেকে বিদেশেও পাঠায়। কিন্তু তাকে ইতালিতে নিয়ে যায়নি। দুবাই হয়ে রিপনকে লিবিয়ায় পাচার করা হয়। পাচারের পর দালালচক্র ওই যুবকের নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ২১ লাখ টাকা নেন। এখনো দালাল চক্র তাদের কাছে টাকা দাবি করে যাচ্ছে। কিন্তু রিপনের পরিবার পাঁচ মাস ধরে ছেলের কোনো ভিডিও পাচ্ছে না। এমনকি জানতেও পারছে ছেলে কোথায়।
ইতালি নেওয়ার কথা বলে রিপনের সঙ্গে লিবিয়ায় পাচার হয়েছেন আরেক যুবক মাছুম মোল্লা। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নে। তার পরিবারও এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৩৫ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। দুই ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, ছেলেদের নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে দালাল চক্র তাদের কাছ থেকে সর্বমোট ৭১ লাখ টাকা নিয়েছে। এখন নতুন করে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। তবে সর্বশেষ গত পাঁচ মাস ধরে দুই যুবকের কোনো সন্ধান মিলছে না।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ভুক্তভোগী দুই পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলন রিপনের বাবা সাদেক শিকদার বলেন, দালাল মোজাম্মেলের কথায় মৌখিক চুক্তিতে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাসপোর্টের সাথে দুই লাখ টাকা দিই। এর পর জমি বিক্রি করে ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি ১৩ লাখ টাকা দিই। সব টাকা মোজাম্মেল হোসেনই নেয়। ডকুমেন্টস চাইলে পরবর্তী সময়ে দেবেন বলে জানায়।
তিনি বলতে থাকেন, ‘গতছরের ২৮ জানুয়ারি রাতে পাঁচ/ছয়জনের সঙ্গে রিপনকেও দুবাই নিয়ে যায়। মোজাম্মেল জানায়, দুবাই হয়ে ফ্লাইট ইতালি যাবে। ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ছেলে ইমুতে কল দিয়ে জানায়, তাকেসহ আরও সাত/আটজনকে দুবাই থেকে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। তাদের আর ইতালি নেবে না। ছেলের এমন সংবাদ শুনে মোজাম্মেলকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, চিন্তা করবেন না। ১০/১৫ দিনের মধ্যেই তারা ইতালি পৌঁছে যাবে। তার কথা বিশ্বাস করে থাকি। এরপর ২৪ মার্চ ছেলে কল করে জানায়, দালালরা তাকে আটক করে রেখেছে। মারপিটের বিভিন্ন ভিডিও এবং অডিও ক্লিপস পাঠায়। তাদের কাছ থেকে ছেলেকে মুক্ত করতে নতুন করে ২৫ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়।’
সাদেক শিকদার বলেন, ‘এ কথা শুনে ঢাকার অফিসে গেলে সেটা বন্ধ পাই। তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পরিবারের সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ছেলের বউ অন্তঃস্বত্ত্বা। তার মা হওয়ার সময় চলে এসেছে। ছেলের মা অস্থির হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মোজাম্মেলের দেখা পেলে তিনি বলেন, ছেলেকে বাঁচাতে হলে টাকা দাও। তখন ছেলেকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বিক্রি করে ফের ২১ লাখ টাকা বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দিই। আমি সর্বমোট ৩৬ লাখ টাকা দিয়েও ছেলেকে ফেরত পাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘দালালচক্র নতুন করে আবার ২০ লাখ টাকা দাবি করছে। টাকা না দিলে ছেলেকে আর ফিরে পাব না বলেও জানায় চক্রটি। বিষয়টি কাউকে জানালে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। অন্যদিকে চার/পাঁচ মাস ধরে ছেলের কোনো খোঁজ-খবর পাচ্ছি না। এর পর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গুলশান থানায় গিয়ে একটি মামলা করি। মামলার পর পুলিশও কোনো কাজ করছে না। মোজাম্মেল হোসেন রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হলেও তাকে রিমান্ডে এনে দায়সারা রিপোর্ট দিয়েছেন আদালতে। এর পর আরেক আসামিকে পেয়ে ফোন করলেও গুলশান থানার এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পলাশ আহমেদ গ্রেফতারে অনীহা প্রকাশ করেন। এর পর ওই আসামিকে ৯৯৯ কল করে অন্য এসআইকে দিয়ে গ্রেফতার করানো হয়।’ পুলিশ মোজাম্মেল হোসেন চক্রের কাছ থেকে টাকা খেয়ে কোনো কাজ করছে না বলেও অভিযোগ করেন লিবিয়ায় জিম্মির শিকার রিপন শিকদারের বাবা সাদেক শিকদার।
ছেলেকে ফেরত পেতে সরকাররের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যা টাকা গেছে যাক। পথের ফকির হয়েছি, সমস্যা নাই। এখন ছেলেকে জীবিত ফেরত পেলেই সব কষ্ট ভুলে যাব। তার ছোট একটি ছেলে রয়েছে, স্ত্রী রয়েছে। শিশুটি এখনো তার বাবাকেও দেখেনি। এই দালাল চক্রকে ধরলেই আমার ছেলেকে ফেরত পাব বলে আশা করছি।’ এ সময় সাদেক শিকদার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার কান্না দেখে রিপনের মা, তার শিশুসন্তান ও স্ত্রীসহ উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সংবাদ সম্মেলনে আরেক ভুক্তভোগী মাছুম মোল্লার ছোট ভাই আশরাফুল মোল্লা বলেন, ‘২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে পারুলিয়া বাজারে মৌখিক চুক্তি হয় যে, ১৮ লাখ টাকায় মাছুমকে ইতালি পাঠাবে। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর পাসপোর্টের সঙ্গে প্রথম তিন লাখ টাকা দিই। এর পর ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মোজাম্মেলের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা দিই। এরপর ২৬ জানুয়ারি অফিসে গিয়ে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে আসি। তারা ২৮ জানুয়ারি আমার ভাইকে দুবাই নিয়ে যায়। তখন জানায়, পাঁচ দিন পর ইতালির ফ্লাইট হবে। এর পর ৭ ফেব্রুয়ারি ভাই কল করে জানায়, সাত/আটজনকে ইতালির ফ্লাইট না দিয়ে দালালের মাধ্যমে লিবিয়া নিয়ে আসে।
তিনি বলতে থাকেন, ‘২৪ মার্চ দালালচক্র মারপিটের ভিডিও এবং অডিও ক্লিপস পাঠিয়ে জানায়, নতুন করে ২৫ লাখ টাকা লাগবে। না হলে ভাইকে মেরে ফেলা হবে। ভাইকে বাঁচাতে এর পর পর্যায়ক্রমে আরও ১৭ লাখ টাকা মোজাম্মেলের সরবরাহ করা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে দিই। বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট ৩৫ লাখ টাকা দিলেও ভাইকে ফেরত পাচ্ছি না। অন্যদিকে আইনের আশ্রয় নিয়েও কোনো সুরাহা মিলছে না। কারণ, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।’
আশরাফুল মোল্লা বলেন, ‘এখন একটাই দাবি, যাতে ভাইকে ফেরত পাই। মারা গেলেও যেন অন্তত জানতে পারি, তিনি মারা গেছেন। আর বেঁচে থাকলে যেন জীবিত ফেরত পাই।’
এ বিষয়ে জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই পলাশ আহমেদকে মোবাইল ফোন কল করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মোট পাঁচজনের নামে মামলা হয়েছে। দু’জন গ্রেফতার হয়ে জেল-হাজতে রয়েছেন। বাকি তিনজন পলাতক। বাদীপক্ষ চাইলে আদালতের মাধ্যমে সিআইডি বা পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত চাইতে পারেন। তাদের জন্য সব পথ খোলা রয়েছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম