রংপুরে যেভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায় দেশের তৃতীয় শহিদ মিনার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০
রংপুর: যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় ও তার তাৎপর্যকে তুলে ধরতে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ; যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে ঘটনার গুরুত্ব ও ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক সহজ হয়। সেজন্যই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য যারা আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, তাদের স্মরণে নির্মিত হয় শহিদ মিনার।
তাই প্রতিবছর মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহর থেকেই কেন্দ্রীয় থেকে জেলা, উপজেলা থেকে শিক্ষাঙ্গন সবখানেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতির মিনার। কিন্তু এসব শহিদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। বিশেষ করে রংপুরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারটি কখন, কীভাবে, কাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল তা অনেকেরই আজানা। এই স্মৃতির মিনারটি প্রচার প্রচারণা না থাকায় অনেকেই বিষয়টি জানেন না। এই স্মৃতির মিনারটি নির্মাণের পেছনের গল্পটি অতটাও সহজ ছিল না।
রংপুরের সাংস্কৃতিক পল্লি বলে খ্যাত পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের পূর্ব কোণে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারটি। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে প্রথমে রাজশাহী কলেজ এবং ঢাকার পর রংপুরে শহিদ মিনার নির্মাণ হয়েছিল। রংপুরে নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারটি সারাদেশের মধ্যে তৃতীয়। এখানেই পালিত হয় সকল জাতীয় দিবস, পরিবেশিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সভা-সমাবেশ।
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত পর্যাপ্ত বই ও সেসময়ের লিখিত পাণ্ডুলিপি না থাকায় রংপুরে নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারটি যে সারাদেশের মধ্যে তৃতীয় বর্তমান প্রজন্মের তা একেবারেই অজানা। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া একাধিক ভাষাসৈনিক জানান, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চার বছর পর ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ভাষা শহিদদের স্মরণে রংপুরের ভাষা সৈনিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের পূর্ব কোণে ইট-বালু, কাদামাটি দিয়ে গড়ে ওঠে প্রথম শহিদ মিনার। যদিও প্রথম গড়া সেই শহিদ মিনারটি আজ আর নেই।
অসীম সাহস আর মনোবল নিয়ে সেদিন ছাত্র নেতাদের প্রচেষ্টায় ইট-বালু, কাদামাটি দিয়ে রাতারাতি মাথা তুলে দাঁড়ায় শহিদ মিনার। পরবর্তী সময়ে রংপুরের স্থানীয় রাজনীতিবিদদের উদ্যোগে ইটের গাঁথুনি দিয়ে সেখানে শহিদ মিনার নির্মিত হলেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে তৎকালীন পৌর পরিষদ একটি পূর্ণাঙ্গ শহিদ মিনার নির্মাণ করে।
৬৭ বছর আগে রংপুরে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণের দুঃসাহসিক রাতের স্মৃতি এখনো ভুলে যাননি প্রবীণ রাজনীতিক ও ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল। রংপুরে নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারটি সারাদেশের মধ্যে তৃতীয় শহীদ মিনার বলে নিশ্চিত করে এ ভাষা সৈনিক।
সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রনেতারা উদ্যোগ নেয় শহিদ মিনার নির্মাণের। ভাষা সৈনিক তবিবর রহমানের বাড়িতে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্দেশ্যে আমিনুল ইসলাম, খয়রুল ইসলাম, নজমুল আলম হেবিন, ছোট ভাই জেবিন, গোলাম রব্বানী বুলবুল, মকসুদার রহমান, সুফী মোতাহার হোসেন, মীর আনিছুল হক পেয়ারাসহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে আলোচনা সভা হয়।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘ওই দিন রাতেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শুরু হয় তোড়জোড়। সেদিন রাতে অল্প সময়ে নির্মাণসামগ্রী কোথায় পাব- এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। ওই দিন রংপুর শহরের গুপ্তপাড়া নিউ ক্রস রোডের ডাক্তার মোজাহার হোসেন চাচার বাড়ির নির্মাণ কাজ চলছিল। সেখান থেকেই আনা হলো ইট। তবে মিলল না সিমেন্ট আর বালু। সিমেন্ট আর বালু না থাকলে কি হবে; ওই মুহূর্তেই রংপুর হাইস্কুলের পুকুর থেকে আনা হলো কাঁদা। ইট আর কাঁদা দিয়েই গড়ে উঠল প্রথম শহিদ মিনার। রাতারাতিই সাদা চুনের প্রলেপ পড়ল। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে যথারীতি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহিদ মিনার।’
জানা যায়, সেদিন রাতের আঁধারে শহিদ মিনার নির্মাণের বিষয়টি জানাজানি হলে পরদিন অস্থায়ী সেই শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষজন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে সেখানেই ১৯৮০ সালে পূর্ণাঙ্গ শহিদ মিনার নির্মাণ করেন। জীবনভর রাজনীতি করা মানুষটি ওই কাজের উদ্যোক্তা হওয়াকে তার জীবনের সবচেয়ে গর্বের বিষয় বলে জানান।
ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ‘এ শহিদ মিনার নির্মাণে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকেই আজ আর নেই। সেই প্রথম শহিদ মিনারটিও নেই। ৫৮ সালে আইয়ুব খাঁর মার্শাল ল’র সময় সরকারি লোকজনের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরে তার সংস্কার করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক সেনারা সেটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলে। পরবর্তী সময়ে আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে পাবলিক লাইব্রেরির অনুমোদন সাপেক্ষে তৃতীয় দফায় সেখানে নতুন করে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয় বর্তমান এ শহিদ মিনারটি। যা এখন রংপুরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।’
জানা যায়, বর্তমানে যে শহিদ মিনারটি স্ব-গর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিনা পারিশ্রমিকে, সেটির মনোরম স্থাপত্যের নকশা প্রণয়ন করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্থপতি নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে তাজু চৌধুরী।
সারাবাংলা/পিটিএম