Sunday 23 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বস্তির মেট্রোযাত্রায় অস্বস্তি বাড়ছেই

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:২৬

মেট্রোরেল। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন আসছে না। ততক্ষণে প্লাটফর্মে পা ফেলার জো নেই। ট্রেন এসেছে, যাত্রীও প্রবেশ করেছে, কিন্তু দরজা বন্ধ হচ্ছে না। ছোট মনিটরে লেখা উঠছে ‘এই ট্রেনটি ছেড়ে যেতে কিছুটা বিলম্ব হবে।’ কিছুক্ষণ পর পর ঘোষণাও দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো এই বিলম্ব ১০ মিনিটে গিয়ে ঠেকছে। মেট্রো চলাচলে এমন সমস্যা প্রায়ই দেখা যাচ্ছে।

শুধু এই সমস্যাই নয়, কখনো ওড়না, কখনো ফানুস আবার কখনো অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে দরজা বন্ধ হতে বিঘ্ন ঘটে। ফলে বন্ধ রাখতে হয় মেট্রোরেল চলাচল। এতে যাত্রীরা পড়েন ভোগান্তিতে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একক যাত্রার টিকিট বিড়ম্বনা। এখনো একক যাত্রার টিকিট সংকট। এই ভোগান্তির মধ্যেও ইদানিং ঢুকে পড়ছে পকেটমার। মেট্রো যাত্রায় সর্বস্ব খোয়ানোর ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।

বিজ্ঞাপন

জনবল সংকটে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে কিছুটা উল্লেখ করে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড- ডিএমটিসিএল বলছে, জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। নতুন জনবল নেওয়া হলে সমস্যা কেটে যাবে।

প্রায়ই দেখা দিচ্ছে যান্ত্রিক ত্রুটি

যানজটের ভোগান্তি থেকে স্বস্তি দিতে কম সময়ে যাতায়াতে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পৌনে ১২ কিলোমিটার মেট্রোলাইনে ট্রেন চালু করা হয়। এর এক বছর পর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরো অংশের কাজ শেষ করে যাত্রী চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে নানা কারণে সাময়িক বন্ধ রাখা হয় মেট্রোরেল। কখনো বৈদ্যুতিক তারে ফানুস আটকে, কখনো ঘুড়ি আটকে, আবার লাইনে ওড়না পরে গেলেও মেট্রো চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে। আবার আশেপাশের ভবন থেকে ঢিল ছুড়ে মেট্রোরেলের গ্লাস ভাঙায় সাময়িক বন্ধ ছিল মেট্রোরেল।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। লাইনের ভায়াডাক্ট অংশের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে যায়। ওই ঘটনায় ১১ ঘণ্টা মেট্রো চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। এ ছাড়া, দরজার মধ্যে সেফটি পিন, ওড়না ও যাত্রীদের আটকে পড়ার ঘটনায় সাময়িক ট্রেন চলাচল বন্ধ এখন নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। তবে একটি ট্রেনে এমন সমস্যা দেখা দিলে বাকি ট্রেনগুলোও বন্ধ থাকে।

যাত্রীরা বলেন, প্রায়ই শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। সরেজমিনেও দেখা গেছে, কোনো স্টেশনে ট্রেন থামার পর যাত্রী উঠে গেলেও স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয় না। কিছুক্ষণ পর শোনা যায় ট্রেনটি এই স্টেশনে সাময়িক বিলম্ব হবে। এ প্রসঙ্গে সদ্য বিদায় নেওয়া ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে সমস্যা সৃষ্টি করে মানুষ। অনেক সময় যাত্রীরা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তখন সেটায় চাপ পড়ে। পরে দরজা খুলতে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এটি এমন একটি যানবাহন যেখানে সব সিস্টেমে চলতে হবে। সামান্য নিয়মের বাইরে গেলেই আর চলবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিস্টেমেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। যেমন ফানুস উড়ে পড়ল, কিংবা লাইনে গাছের ডাল ভেঙে পড়ল- ওটা আমাদের হাতে নেই। অনেক সময় দেখা যায় সফটওয়্যারে সমস্যা। আবার বিদ্যুতের ভোল্টেজ বাড়লে-কমলেও সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়।’ আব্দুর রউফ বলেন, ‘জনবল কম রয়েছে। এখানে তো প্রশিক্ষণ ছাড়া লোক দেওয়া যায় না। তাই এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’

একক যাত্রার টিকিট সংকট

মেট্রোরেল যাত্রীদের জন্য দুই ধরনের টিকিট রয়েছে। একটি এমআরটি পাস বা র‍্যাপিড পাস, অন্যটি একক যাত্রার টিকিট। র‍্যাপিড পাস কেনা যাত্রীরা টাকা না শেষ হওয়া পর্যন্ত যেকোনো সময় যাত্রা করতে পারেন। আর একক যাত্রা করা যাত্রীদের স্টেশন থেকে তাৎক্ষণিক টিকিট কিনে যাত্রা করতে হয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় সেই টিকিট ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে বর্তমানে মেট্রোরেল যাত্রীদের জন্য একক যাত্রার টিকিটের সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে একটি টিকিটের জন্য।

মেট্রোযাত্রার শুরুতে একক যাত্রার ২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪১টি টিকিট স্টেশনগুলোতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত অক্টোবরে ডিএমটিসিএল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানায়, ২ লাখ ৪০ হাজারের মতো একক যাত্রার টিকিট খোয়া গেছে। খোয়া যাওয়া টিকিটগুলো যাত্রীদের কাছে রয়েছে- এমন ধারণা থেকে সেগুলো ফেরত চেয়ে যাত্রীদের কাছে অনুরোধ জানানো হয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই সময় মেট্রো চলাচলে একক যাত্রার টিকিটের তীব্র সংকট দেখা দেয়। যাত্রীদের চাপ সামলাতে কখনো কখনো প্রবেশ পথে একক যাত্রার যাত্রীদের প্রবেশে নিরুৎসাহিত করতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর পর গত ডিসেম্বরে আসে ২০ হাজার নতুন টিকিট। কিন্তু তাতেও সংকুলান হচ্ছে না।

এখনো সকাল কিংবা সন্ধ্যায় মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশনটি যাত্রীতে পরিপূর্ণ থাকে। কখনো কখনো লাইন বাইরের প্রবেশ সিঁড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যায়। যাত্রীদের অভিযোগ, কখনো কখনো ঘণ্টা পার হয়ে যায় একটি টিকিট সংগ্রহ করতে। উত্তরা পথের যাত্রী ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে কথা হয় মতিঝিল স্টেশনে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘৪০ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে কখনো স্ত্রীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি, আবার কখনো বাচ্চাদের নিয়ে অন্যত্র বসছি। উত্তরা যাব যানজট এড়িয়ে সেজন্য মেট্রো স্টেশনে আসা। এখন দেখছি স্টেশনেই ঘণ্টা কেটে যাবে।’

মিরপুরের যাত্রী মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক মাস ধরে র‍্যাপিড ও এমআরটি পাস কেনার জন্য ঘুরছি। কোথাও পাচ্ছি না। যে কারণে এই দুর্ভোগ পেরিয়ে একক যাত্রার টিকিট কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছি। একদম ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।’ টিকিট সংগ্রহ করা আরেক যাত্রী আসিফ বলেন, ‘এখানে নানা সমস্যা। যেমন আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে যাওয়ার পর বলে ভাংতি টাকা নাই। এখন আমি টাকা ভাঙিয়ে ফের লাইনে দাঁড়াব? কোনো কথাও বলে না তারা। এটা কেমন ধরনের সেবা বলুন?’

অনেক স্টেশনেই ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট

মতিঝিল স্টেশনে ভিড় দেখা গেলেও অন্য স্টেশনগুলোতে এত চাপ সাধারণত দেখা যায় না। তবে কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের চাপ থাকে মোটামুটি। দুই দিন আগে কারওয়ানবাজার স্টেশনে দুপুরে দেখা গেলো দীর্ঘ লাইন। কারণ ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট। চারটি ভেন্ডিং মেশিনের দু’টি নষ্ট থাকায় চাপ পড়েছে বাকি দুইটাতে। এমন পরিস্থিতি শাহাবাগ, টিএসসি, মিরপুর-১২, এমনকি কখনো কখনো মতিঝিলেও দেখা যায়।

স্টেশনের কর্মীরা বলেন, সবগুলো মেশিন কখনোই চালু থাকে না। কখনো দুইটা নষ্ট, দুইটা চালু থাকে। আবার কখনো একটা মেশিন নষ্ট, আরেকটা চালু থাকে। এভাবেই চলছে। তবে যাদের এমআরটি বা র‍্যাপিড পাস আছে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যাত্রীরা বলছেন, অনেক সময় টিওএমে ভাংতি টাকা থাকে না। ফলে একক যাত্রার টিকিট পেতে সমস্যা হয়।

এ প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল’র মহাব্যবস্থাপক ( অপারেশন) মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেট্রোরেলের কিছু স্টেশনে মাঝে মধ্যে এ সমস্যা হচ্ছে। মেশিনে ত্রুটি দেখা দেয়। তবে জানা মাত্রই ঠিক করা হয়। প্রতিটি ভেন্ডিং মেশিনের ওয়ারেন্টি রয়েছে। তাই এগুলো স্থায়ীভাবে খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই।’

যাত্রী বেশে পকেটমার

এই ভোগান্তির মধ্যে নতুন আতংকের নাম পকেটমার। কম সময়ে যানজটের তিক্ততা এড়াতে অনেকেই মেট্রোরেলে ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দ্য মনে করেন। তাই যতই ভিড় হোক না কেন মেট্রোতেই যাতায়াত করেন। কিন্তু ইদানিং এই ভ্রমণ আতংকে রূপ নিয়েছে কারও কারও কাছে। কারণ ভিড়ের মধ্যে যাত্রী হয়ে টিকিট কেটে মেট্রোতে উঠে হাতিয়ে নিচ্ছেন মানিব্যাগ-মোবাইল।

শুধু পুরুষ কামরাতেই নয়, মেয়েদের কামরাতেই ঢুকে পড়ছে পকেটমার। নারী-পুরুষ উভয়েই টিকিট কেটে মেট্রোতে উঠে যাত্রীদের কাছে যা পাচ্ছেন হাতিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এসব ঘটনা বন্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। মাঝে-মধ্যে যাত্রীদের পকেটমার থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। সম্প্রতি সচিবালয় স্টেশনে ‘পকেটমার থেকে নিরাপদে থাকুন, আপনার মোবাইল, মানিব্যাগ হেফাজতে রাখুন- এমন সতর্ক বার্তা দিতে দেখা গেছে।’

যানজটের ভোগান্তি কমাতে রাজধানীতে চালু করা হয়েছিল মেট্রোরেল। উত্তরা-মিরপুর-মতিঝিল পথের যাত্রীদের কাছে মেট্রোরেল যেন যাতায়াতে আশীর্বাদ। কিন্তু দিন দিন অব্যবস্থাপনার কারণে স্বস্তির মেট্রোযাত্রা অস্বস্তিতে পরিণত হচ্ছে।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

অস্বস্তি একক টিকিট পকেটমার ভেন্ডিং মেশিন মেট্রোরেল যাত্রা যান্ত্রিক ত্রুটি সংকট

বিজ্ঞাপন

২২তম দিনে মেলায় নতুন বই ৬৭টি
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৫১

ডিএসসিসিতে চলছে ‘ক্লিন সপ্তাহ-২০২৫’
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:১২

আরো

সম্পর্কিত খবর