সাজেকে অগ্নিকাণ্ড
ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা ও সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা মানেননি ব্যবসায়ীরা
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০২:৪৫
রাঙ্গামাটি: মেঘ-পাহাড়ের উপত্যকা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র ‘সাজেক ভ্যালি’। দেশের পর্যটনশিল্পে সাজেক উপত্যকা পর্যটক ও বিনোদনপ্রেমী মানুষের কাছে পছন্দের শীর্ষে। সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের হঠাৎ আগুনে ‘অগ্নি পুরীতে’ পতিত হয়েছে সাজেক ভ্যালি। আগুনের ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১০০টির মতো স্থাপনা পুড়ে যাওয়ার খবর জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
পাহাড়ের চূড়ায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার ফলে সাজেক ভ্যালিতে সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকট সঙ্গত কারণেই রয়েছে। তবে ক্রমাগত এত বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও ছিল না যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দিয়েও ঝুঁকি মোকাবিলায় কটেজ-রিসোর্ট মালিকদের কাছ থেকেও সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রাঙ্গামাটির ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়।
রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয় বলছে, সাজেক কটেজ মালিক সমিতির নেতাদের সাজেক ভ্যালি উপত্যকায় পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা (রিজার্ভার) রাখা, লাইসেন্স নেওয়া, অগ্নিনির্বাপক স্প্রে ও কটেজ-রিসোর্টের জনবলকে যথাযথ ট্রেনিং দেওয়ার বিষয়ে বারবার বলা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এর আগেও সাজেকে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারই সবচেয়ে বেশি।
যত্রতত্র স্থানে রিসোর্ট-কটেজ নির্মাণ, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ও খালি স্থান না রাখার ফলেও ঝুঁকি বেড়েছে সাজেক ভ্যালিতে। হঠাৎ এক অগ্নি ট্র্যাজেডিতে পুড়ল সাজেক ভ্যালির প্রায় ১০০টির মতো স্থাপনা। শুধু রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ভ্যালি উপত্যকাই নয়, পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথাযথ অব্যবস্থাপনা রয়েছে তিন পার্বত্য জেলাজুড়েই। এ নিয়ে নীতিমালা কিংবা গাইডলাইন তৈরি প্রয়োজন মনে করছেন স্থানীয় খাতসংশ্লিষ্ট ও পর্যটন বিশেষজ্ঞরা।
রাঙ্গামাটির প্রথম ইকো রিসোর্ট রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদের পাড়ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাঙ্গামাটির বেশকিছু রিসোর্ট ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বাকিসব রিসোর্টগুলোয় পানি সংকট আছে। অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি কিংবা অগ্নিনির্বাপণ সুব্যবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, ‘সাজেকের আজকের দুর্ভাগ্যজনক অগ্নিকাণ্ড পর্যটন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সামনে বেশকিছু প্রশ্ন হাজির করেছে। প্রথমত, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকা; নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রিসোর্টের কটেজ নির্মাণ ও রিসোর্ট স্থাপন সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকা। ফলে যে যার মতো কটেজ নির্মাণ করছে ও ঘন ঘন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- শহর থেকে দূরে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোতে ফায়ার সার্ভিস ইউনিট নেই। সেইসঙ্গে সেসব রিসোর্ট বা কটেজগুলোতে নিজস্ব প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছোট কূপ খনন করে পানির রিজার্ভ রাখা, ফায়ার স্টিংগুইসার রাখা, বালি মজুদ রাখা ইত্যাদি রাখা উচিত। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পাহাড়ের প্রাকৃতিক ও প্রতিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনা না করে রিসোর্ট ও কটেজ স্থাপন করা। পাহাড়ের অতিসম্ভাবনাময়ী পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করার জন্য এসব বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।’
রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের স্নাতক (সম্মান) ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে রোববার সাজেক ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে গিয়েছেন বিভাগটির চেয়ারম্যান মোসা. হাবিবা ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক খোকনেশ্বর ত্রিপুরা।
খোকনেশ্বর ত্রিপুরা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আজ (সোমবার) সকালেও কয়েকজন মিলে ভাবছিলাম যেভাবে সাজেকে গণহারে রিসোর্ট-কটেজ হচ্ছে, এতে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে। এর মধ্যেই দুপুরে এই ঘটনা ঘটল। আমরা এখানে এসে অনুধাবন করেছি, এত গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রে ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়, হাসপাতালসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপনা এখানে নেই।’
তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক দূর থেকে সুপেয় পানি আনতে হয়। ফলে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখাও প্রয়োজন। কেবল সাজেক ভ্যালির ক্ষেত্রেই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রেও কটেজ-রিসোর্টের বিষয়ে অন্তত মিনিমাম গাইডলাইন থাকা উচিত। শুধু কর্মাশিয়াল বিষয়গুলোকে দেখলেই হবে না। ঝুঁকি-নিরাপত্তার বিষয়গুলোও ভাবতে হবে।’
রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের সদ্য সাবেক সহকারী পরিচালক মো. দিদারুল আলম। যিনি বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলার সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সাজেক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাঙ্গামাটি জেলায় দায়িত্ব পালন করেছি। সাজেক ভ্যালির কটেজ-রিসোর্ট সমিতির নেতাদের আমি বারবার বলেছি, আপনারা সাজেকে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় উদ্যোগ নিন।’
তিনি বলেন, ‘তিনটি বিষয়ে আমরা তাদের বলেছি। যেমন- অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা, লাইসেন্স নেওয়া ও জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা সবধরনের সহায়তার কথা জানালেও তারা উদ্যোগী হননি। যদি তারা বিষয়টিগুলোকে প্রাধান্য দিতেন সেক্ষত্রে আজকের এই ঘটনা হয়তো এত বড় হতো না। এখান থেকে তাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। সেইসঙ্গে সবাইকে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তেরাঁ আইন ২০১৪ এর ২ এর ১৩ ধারা অনুযায়ী কটেজ-রিসোর্ট মালিকদেরও এই আইন অনুযায়ী লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাজেক ভ্যালির কটেজ রিসোর্টগুলোর মধ্যে কয়টি আইন মেনে লাইসেন্স নিয়েছে, আর কয়টি নেয়নি- সেটি যাচাই করে দেখার পর জানতে পারব। আর যারা আইন মেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেননি- তাদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
সারাবাংলা/পিটিএম