Tuesday 25 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সরকারি ক্রয় খাত কয়েকজন ঠিকাদারের কাছে জিম্মি: টিআইবি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩০ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:০৯

রাজধানীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে টিআইবির সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, সরকারি ক্রয় খাত কয়েকজন ঠিকাদারের কাছে জিম্মি। সংস্থার জরিপ ও গবেষণায় দেশের সরকারি ই-প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) ব্যবস্থায় বাজার দখল, ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে।

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, “পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি ক্রয় খাত সবচেয়ে দুর্নীতি প্রবণ। তবে, বেশিরভাগ দেশেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণ না হয়ে বরং এটি আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায় সেটির একটি চিত্র উঠে এসেছে।”

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে ই-জিপি চালুর পর থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫,৯৬,৯২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে, সর্বোচ্চ অনুমোদিত চুক্তির মূল্য ৮৮১ কোটি টাকা হলেও এর চেয়ে বড় চুক্তিগুলো এখনও এই প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার প্রবণতা রয়েছে। শীর্ষ ৫% ঠিকাদার মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৬১.৩১% নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে সর্বনিম্ন ১০% ঠিকাদারদের দখলে রয়েছে মাত্র ১%-এরও কম বাজার।

বিশেষ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫% ঠিকাদার মোট প্রকল্পমূল্যের ৭৪.৯৬% নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া, গত এক দশকে শীর্ষ ঠিকাদারদের বাজার দখলের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ 

বিজ্ঞাপন

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ (আরটিএইচডি): মাত্র ১১% ঠিকাদার ৯৩.৫৫% প্রকল্পমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। ১% ঠিকাদারই ৭২.৯% বাজার দখল করেছে। এই বিভাগে ৯টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়: ৯% ঠিকাদার মোট প্রকল্পমূল্যের ৯১.৫% নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র ৩৮ জন ঠিকাদার ৩০.৯% বাজার দখল করেছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়: ৭.৪৫% ঠিকাদার ৭১% বাজার শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করছে। ৮১ জন ঠিকাদার ৩২.৩২% বাজারের মালিক।

স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি): ৯.৭৪% ঠিকাদার মোট প্রকল্পমূল্যের ৬২.৮৮% নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র ১% ঠিকাদার (২৯৪ জন) ২৭.৭% বাজার দখল করেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারদের আধিপত্য: টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ (জেভি) গঠন করে বড় প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে তাদের বাজার দখল আরও বেশি হয়।

এছাড়া, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্য বদলে যায়। যেমন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পরিবর্তনের পর শীর্ষ ১০ ঠিকাদারের তালিকা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়েও মন্ত্রী পরিবর্তনের পর শীর্ষ ঠিকাদারদের তালিকায় বড় পরিবর্তন এসেছে।

টিআইবি’র সুপারিশ: টিআইবি সরকারি ই-প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে—

যৌথ উদ্যোগ (জেভি) ফার্মগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যালোচনা করা: স্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও বাজার দখলের প্রবণতা রোধ করা।

একক ঠিকাদার সক্ষম হলে জেভি সীমিত করা: যে ঠিকাদার এককভাবে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, তাকে জেভি গঠনের অনুমতি না দেওয়া।

বাজার দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া: ঠিকাদারদের জন্য বাজার শেয়ারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা: সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মানের নিয়মনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।

প্রকৃত মালিকানা তথ্য প্রকাশ করা: পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সংশোধন করে সকল কোম্পানি ও জেভির প্রকৃত মালিকানা তথ্য উন্মুক্ত করা।

উচ্চমূল্যের চুক্তি ই-প্রকিউরমেন্টের আওতায় আনা: ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের বাইরে থাকা উচ্চমূল্যের প্রকল্পগুলোকে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনা।

টিআইবির পর্যবেক্ষণ: সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি ক্রয় খাত সবচেয়ে দুর্নীতি প্রবণ। তবে, বেশিরভাগ দেশেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণ না হয়ে বরং এটি আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায় সেটির একটি চিত্র উঠে এসেছে।”

তিনি আরও বলেন, ২০১২-২৪ সালের মধ্যে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয় প্রায় ৯২% অর্থ ব্যয় করেছে। এই দশটি মন্ত্রণালয়ের গড়ে ৬১% কার্যাদেশ ৫% ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী প্রকল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে যাচ্ছে, যা সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা হ্রাস করছে।

তিনি আরও বলেন, “স্থানীয় সরকার বা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে ঠিকাদারদের হাত বদল হয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ একই থেকে যায়। সার্বিকভাবে সরকারি ক্রয় খাত একটি জিম্মি অবস্থায় রয়েছে।

টিআইবি বলছে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং প্রকৃত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। তাদের মতে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, বাজার শেয়ার সীমিতকরণ এবং প্রকৃত মালিকানার তথ্য উন্মুক্ত করা হলে ঠিকাদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে এবং সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/আরএস

টিআইবি প্রতিবেদন সরকারি ক্রয় খাত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর