বসতঘর পুড়ে নিঃস্ব ৩৬ লুসাই-ত্রিপুরা পরিবার
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:১১ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৫৩
রাঙ্গামাটি: জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালি উপত্যকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রিসোর্ট-কটেজ মালিকদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন রুইলুই পাহাড়ের লুসাই-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা। পুড়ে যাওয়া ৯৮টি স্থাপনার মধ্যে ৩৬টি ছিল লুসাই-ত্রিপুরারের বসতবাড়ি।
গত সোমবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আগুনের ঘটনায় এসব পরিবারের সবার রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে, কেউ কেউ কাটিয়েছেন গির্জা, মন্দির বা উপসানালয়ে। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের চোখে-মুখে ভয়াল দিনের বিভৎসতার ছাপ। মুহুর্তের মধ্যে সব হারানো পাহাড়িরা এখন ভাবছেন কিভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াবেন।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন, সাজেক রিসোর্ট ও কটেজ মালিক সমিতির তথ্য মতে, আগুনে লুসাই জনগোষ্ঠীর ১৬টি ও ত্রিপুরাদের ২০টিসহ মোট ৩৬টি বসতঘর পুড়ে গেছে। ৩৬ পরিবারের প্রায় দু’শর কাছাকাছি মানুষ এখন বাসস্থান সংকটে।
ক্ষতিগ্রস্ত মিঠুন ত্রিপুরা বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ঘর যা ছিল, সব পুড়ে ছাই। ঘরে ধান ছিল, সব পুড়ে গেছে। আমরা এখন কী খাব, খাওয়ার মতো আর কিছু নেই। ঘরের পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো দেখে দেখে খোলা আকাশে নিচে সারারাত কাটিয়েছি। চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি।’
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি রঞ্জন ত্রিপুরা। তিনি জানান, তিনি ঘর থেকে কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। ঘর পুড়ে গেছে মানে সব শেষ। তিনি এখন সব হারিয়ে কাঁদছেন। চেয়েছেন প্রশাসন ও সরকারের সহযোগিতা।
ক্ষতিগ্রস্ত লেবিট লুসাই বলেন, ‘এখানে যে সব বাড়ি ঘর পুড়ে গেছে সব আমরা আত্মীয়-স্বজন। একেক জনের একেক রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেকের আদা, আবার অনেকে হলুদ পুড়ে গেছে। এখন একদম রাস্তায় থাকা ছাড়া আর আমাদের কোনো উপায় নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।’
১৬৭ নম্বর রুইলুই মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) লাল থাঙ্গা লুসাই বলেন, ‘সাজেকে এত বড় অগ্নিকাণ্ড আগে কখনো ঘটেনি। আমার ঘর বিল্ডিংয়ের, তবুও পুড়ে একদম ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। থাকার মতো এখন আর অবস্থা নেই।’
এদিকে, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের সাময়িক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সাজেক কটেজ ও রিসোর্ট মালিক সমিতি। সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিজয় ত্রিপুরা বলেন, ‘আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়দের আমরা সমিতির পক্ষ থেকে ও আশেপাশের পাড়ার লোকজন মিলে সোমবার রাতে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে পরনের কাপড় ছিল তা নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছি আমরা। পায়ে জুতা পরার সুযোগ পাইনি। আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তে চারিদিকে ছড়িয়েছে পড়েছিল। এখন গায়ে যা আছে তাই দিয়ে আমরা পরিবার নিয়ে খোলা আকাশে রাত কাটাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী ও পাড়ার আশেপাশে স্থানীয় লোকজন তাদের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছে। যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে তারা অনেকে খোলা আকাশে আবার অনেকে মন্দির, গীর্জায় রাত কাটিয়েছে।’
সাজেক ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অনিত্য ত্রিপুরা বলেন, ‘সোমবার থেকে আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, সাজেক কটেজ মালিক সমিতি মিলে খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। যে সমস্ত ত্রিপুরা, লুসাই জনগোষ্ঠীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। জুম চাষ, হলুদ চাষ করে তাদের জীবন চলে। এখন যদি নিঃস্ব মানুষদের সহায়তায় সরকার ও বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন; তাহলে তারা কিছুটা উপকৃত হবেন।’
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাজেকে অগ্নিকাণ্ডে মোট ৯৮টি রিসোর্ট-কটেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত ও ভস্মীভূত হয়েছে। এরমধ্যে কটেজ ৩৫টি, বসতঘর ৩৬টি, রেষ্টুরেন্ট ৭টি ও দোকান ২০টি।
জেলা প্রশাসন সূত্রে আরও জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ও বসতঘরের জন্য ১৫ লাখ ১০ হাজার অর্থ ও ১ হাজার ৮০ কেজি চাল (খাদ্যশস্য) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রতি পরিবার সাড়ে ৭ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল পাবেন এবং প্রতি প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার টাকা করে পাবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে সরকারি মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন গাইডলাইন ২০১২-১৩ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়তা সাজেকের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি। আগামীকাল (বুধবার) ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে।’
তবে সাজেকের আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রশাসনের অর্থ ও খাদ্যশস্য বরাদ্দ অনেক কম হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাঙ্গামাটির সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার। তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালে এসেও অর্থ ও খাদ্যশস্য সহায়তার ক্ষেত্রে সরকার এখনো ২০১২-১৩ সালের গাইডলাইন অনুসরণ করছে। দ্রব্যমূল্যের বাজারদরের সঙ্গে এটি এখনো যুগোপযোগী নয়। আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এটি যুগোপযোগী করা হোক।’
কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি যাচ্ছে কাল:
এদিকে, সাজেক ভ্যালি পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদ্ঘাটনে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি বুধবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রাঙ্গামাটির স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. মোবারক হোসেন জানালেন, বুধবার তারা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবেন।
এই কমিটির অন্য সদস্য সচিব আছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শিরীন আক্তারকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটির অন্য ৩ সদস্য হলেন- রাঙ্গামাটির সহকারী পুলিশ সুপার (বাঘাইছড়ি সার্কেল), রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (দীঘিনালা) সহকারী প্রকৌশলী।
বাংলাদেশের মধ্যে আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ি। আবার এই উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়নও সাজেক। ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন সাজেক।
সারাবাংলা/এইচআই