এখনো অস্বাভাবিক বাজার
রোজার আগেই কাটতে পারে সয়াবিন তেলের সংকট
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৩৩ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৩৮
ঢাকা: রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলসংলগ্ন হাটখোলায় মুদি দোকানের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০টি। প্রায় সব দোকানেই বোতলের সয়াবিন তেল বিক্রি হয়। পাওয়া যায় টিনের কন্টেইনারও। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই এসব দোকানে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা গেছে। এক ও দুই লিটার তেলের বোতল এখন পর্যন্ত নেই। কিছু দোকানে পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও অধিকাংশ দোকানেই সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে যেসব দোকানে পাঁচ লিটার তেল পাওয়া গেছে সেসব দোকানিরাও বোতলপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেশি রাখছেন। তারা বলছেন, বাজারে এখনো তেলের সংকট রয়েছে। আর খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ডিলারদের কাছেই সরবরাহ কম। তাই তারা পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। আর আমদানিকারকরা বলছেন, সরবরাহে ঘাটতি নেই। দুয়েকদিনের মধ্যে তেলের সরবরাহ বাড়বে।
যে কারণে সংকট
দেশে ভোজ্যতেলের এই সংকট গত চার মাস ধরে চলছে। গত বছরের নভেম্বরে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এর পর গত ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আট টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ভোজ্য তেলে শুল্ক-কর কমানোর পরও সংকট কাটেনি। বরং, গত জানুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। এর পর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বাজারে তেলের সরবরাহ কম দেখা গেছে।
পাইকারি তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ সংকটের পেছনে দুটি কারণের কথা জানা গেছে। প্রথমত, বাজারে খোলা সয়াবিন হিসেবে যে তেল বিক্রি হয়, তার বড় অংশ সুপার পামওয়েল। এটি ভালোভাবে পরিশোধন করে তা বিক্রি করা হয়, যা দেখতে প্রায় সয়াবিন তেলের মতো। শীতকালে এই তেল জমাট বাঁধে। এ কারণে শীতকালে সয়াবিন হিসেবে সুপার পাম তেলের বিক্রি কমে যায়। বেড়ে যায় বোতলের বা প্রকৃত খোলা সয়াবিন তেলের বিক্রি। দ্বিতীয়ত, জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ আমদানি হলেও ফেব্রুয়ারির প্রথম তিন সপ্তাহে আমদানি ছিল খুব কম। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ২৫ হাজার টন তেল।
রমজানকে সামনে রেখে ফেব্রুয়ারিতে বাজারে তেলের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু বাড়তি সেই চাহিদা সামাল দেওয়ার মতো আমদানি ধারাবাহিকতা ফেব্রুয়ারিতে ছিল না। এতে সংকট আরও তীব্র হয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থাগুলো দিয়েছে ভিন্ন তথ্য। বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে বোতলের সয়াবিন মজুতের প্রমাণ পেয়েছে তারা। তাদের বক্তব্য, কোম্পানিগুলো এখন সরবরাহ বাড়িয়েছে। তবে কিছু ব্যবসায়ী সয়াবিন তেল মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে খুচরা বাজারে এক ও দুই লিটারের ছোট তেলের বোতল দেখা যাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলের বোতল সরবরাহ করছে না। ক্রেতাদের অভিযোগ, যে গুটিকয়েক দোকানে বোতলের তেল পাওয়া যায় সেখানেও ১৭৫ টাকার সয়াবিন ২০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর গোপীবাগ, হাটখোলা, শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, এজিবি কলোনি, মালিবাগ বাজারের দোকানে এক ও দুই লিটারের বোতলের সয়াবিন তেল নেই। আবার কোনো কোনো দোকানে নেই পাঁচ লিটারের বোতলও। যে কয়েকটি দোকানে তেল পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও দাম চাওয়া হচ্ছে অত্যাধিক বেশি।
ক্রেতারা জানিয়েছেন, যেখানে সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের বোতল ৮৫০ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে দোকানিরা দাম চাইছেন ৮৯০ টাকা। বাজার ভেদে এই দাম কোথাও কোথাও বেশি। আবার এসব তেলের গায়ের নির্ধারিত দামও মুছে দেওয়া হচ্ছে। গোপীবাগ এলাকায় বিসমিল্লাহ স্টোরে কথা হয় ক্রেতা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দোকানে তো তেল-ই নাই। দোকানে বলে রাখি, তিন দিন পর একটা বোতল দেয়, সেটা নিতে আসছি। একসঙ্গে পাঁচ লিটার তেল কেনা মুশকিল। ছোট বোতল নেই, তাই বাধ্য হয়ে নিতে হচ্ছে। পরিচিত দোকান বলে ৮৭৫ টাকা দিয়ে নিলাম।’
বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক শাহাবুদ্দীন সারাবাংলার এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমরা তো ডিলারের কাছেই তেল পাচ্ছি না। গেলেই বলে সরবরাহ নেই। আগে সপ্তাহে দুই দিন পর পর তেল পেতাম। এখন এমন যাচ্ছে যে, কোনো কোনো সপ্তাহে তেল-ই পাচ্ছি না।’ এলাকার প্রায় সব দোকানির অভিযোগ, কোম্পানিগুলো তেল দিচ্ছে না। দিলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বাড়তি দামে বিক্রি করছেন তারা। সালাম স্টোরের মালিক নিশাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘তেল তো পাওয়াই যায় না। যদিও পাওয়া যায় তার সঙ্গে বাজারে কম চলে এমন পণ্য কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
তবে পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান এই অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি কয়েকদিন তৈরি হয়েছিল। এটা কাটতে শুরু হয়েছে।’ রমজানের আগে সরবরাহ বাড়বে বলেও জানান তিনি।
তেলের সংকট কৃত্রিম
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মনিটরিংয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোজ্যতেলের সংকটের বিষয় সামনে আসায় বাজারগুলো ঘুরে দেখেছে তদারকি সংস্থাগুলো। এর মধ্যে অভিযানে গিয়ে বাজারে বোতলের সয়াবিনের পর্যাপ্ত মজুতও দেখেছেন তারা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, বাজারের এই সংকট অনেকটা কৃত্রিম। তারা বাজারে বিভিন্ন সময় গিয়ে অধিকাংশ দোকানেই সয়াবিন পেয়েছেন। এমনকি কিছু দোকানির বাসায় তল্লাশি করেও তেল পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও গোয়েন্দা দফতর থেকে বলা হয়, যথেষ্ট পরিমাণে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। ফলে বোতলের সয়াবিন তেলের সংকট থাকার কথা নয়। বাজারে যেভাবে তেলের সংকট দেখানো হচ্ছে ততটা থাকার কথা নয় বলে জানিয়েছেন তেল সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীরাও। তারা বলছেন, তেল সরবরাহ কিছুটা কম। তবে যেটুকু সরবরাহ আছে, সেগুলোও কিছু দোকানি মজুত করে দাম বেশি নিচ্ছেন। বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন বিক্রয়কর্মীরা দিচ্ছেন ৮৩৭ টাকা দরে। যেটি বিক্রি করার কথা ৮৫০ টাকায়। কিন্তু দোকানিরা দাম নিচ্ছেন ৮৯০ থেকে ৯৫০ টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংরাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কথা বলার জন্য টিম লিডার আছেন। আমি সংশ্লিষ্ট হিসেবে বলতে পারি, মাঝে মাঝে মনে হয় ব্যবসায়ীরাই বেশি শক্তিশালী। কারণ, তাদের নিয়ন্ত্রন করতে গেলে একটা পন্যের লাগাম টেনে ধরে আরেকটার সংকট তৈরি করবেন।’ তিনি বলেন, ‘সামনে পবিত্র রমজান মাস। সংকট যাতে তীব্র না হয় সেজন্য মনিটরিং বাড়ানো হচ্ছে।’
সরবরাহ পরিস্থিতি
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। সেক্ষেত্রে মাসিক চাহিদা দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে আবার সয়াবিন তেলের গড় চাহিদা ৭৯ থেকে ৮৭ হাজার টন। গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (মাসের হিসাবে) সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। একইসঙ্গে তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিন বীজ আমদানিও ছিল ৩১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমদানি হওয়া এই তেল প্রক্রিয়াজাত শেষে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বাজারে থাকার কথা। কিন্তু জানুয়ারির বিপুল আমদানির পরও বাজারে বোতলের সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আমদানিকারকরা যা বলছেন
এ প্রসঙ্গে আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু আগেই বলেছি, একটা সপ্তাহ একটু হ্যাসেল থাকবে। বিশেষ করে ২৬/২৭ তারিখ পর্যন্ত একটু সমস্যা থাকবে।’ দুয়েকদিনের মধ্যে তেলের সরবরাহ বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কানে আসছে বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলব, কাল থেকে আমদানি আরও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকের ভেতরে শঙ্কা তৈরি হয়েছে রমজানে তেলের সংকট বাড়তে পারে। না, রমজানে কোনো সংকট থাকবে না। যেহেতু তেলের দাম বাড়ছে না, তখন সরবরাহ বাড়বে। এতে মানুষের শঙ্কা কেটে যাবে। যদি কেউ মজুতও করে থাকে সেগুলোও বেরিয়ে যাবে।’
এদিকে আমদানি করা তেলের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে এবং তেল খালাস শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। যা দুই/তিন দিনের মধ্যেই খোলা বাজারে চলে আসবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম