লাখো মানুষের শ্রদ্ধা আর আঁখিজলে ‘রাজনীতির বরপুত্র’ নোমানের শেষ বিদায়
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩৮ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: অন্তিম যাত্রায় শেষবারের মতো চট্টগ্রামের প্রিয় প্রাঙ্গনগুলোর স্পর্শ নিয়ে গেলেন ‘রাজনীতির বরপুত্র’ খ্যাত আবদুল্লাহ আল নোমান। স্মৃতিমাখা শহরে কফিনবন্দি হয়ে যেখানেই গেছেন, আঁখিজলে ভেসেছেন মানুষ। লাঠিতে ভর দিয়ে আসা অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে টগবগে তরুণ, সবার চোখই ছলছল।
এর মাঝে বাবাকে নিয়ে সন্তান সাঈদ আল নোমানের আবেগমথিত উচ্চারণ সর্বজনের শোকাতুর মন ছুঁয়ে গেছে। রাজনীতি আর দলমতের ঊর্ধ্বে, ডান-বাম-মধ্যপন্থী, অসাম্প্রদায়িক সুধীজন, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে- শেষযাত্রায় পেয়েছেন সকলের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এভাবেই শেষবিদায় নিয়ে আবদুল্লাহ আল নোমান চিরঘুমের জন্য সাড়ে তিন হাত মাটির বিছানা অলঙ্কৃত করেছেন।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে আবদুল্লাহ আল নোমানের জানাজায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটেছিল। ময়দান পেরিয়ে মানুষের কাতার পৌঁছে যায় আশপাশের সড়কেও।
জানাজা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নোমান ভাই একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ। তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন, শ্রমিক রাজনীতি করেছেন, কৃষক রাজনীতি করেছেন। এভাবেই তিনি গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। আমি নোমান ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম বলেন, ‘১৯৬৮ সালের ১০ আগস্ট আমি আর নোমান ভাই এই চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম। একইদিনে গ্রেফতারের পর আমরা জেলখানায় একসাথে ছিলাম। আমরা যারা ষাটের দশকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে বেড়ে উঠেছি, সেসময় নোমান ভাই আমাদের সামনের কাতারে ছিলেন। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য হয়েছিল, কিন্তু শ্রদ্ধা, সম্মানের সম্পর্ক অটুট ছিল।’
সাঈদ আল নোমান কান্নাজড়িত কন্ঠে উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার বাবার রাজনীতির বয়স ৬৮ বছর। এই বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে উনার রাজনৈতিক পদচারণা ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম ছিল উনার ধ্যানজ্ঞান। রাজনীতির নানা বিষয়ে আমার বাবার মনেও কষ্ট ছিল, অভিমান ছিল, কিন্তু তিনি কখনোই সেটা প্রকাশ করতেন না। বরং নিজেরটা চেপে রেখে নেতাকর্মীদের কষ্ট আর অভিমান নিয়ে উদগ্রীব থাকতেন। আপনারা আর কোনো কষ্ট, কোনো অভিমানের কথা শোনানোর জন্য উনাকে আর কখনো পাবেন না। আপনাদের নোমান ভাই চিরতরে চলে গেছেন।’
জানাজার আগে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহবায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনসহ আরও কয়েকজন নেতা বক্তব্য রাখেন।
সকালে আবদুল্লাহ ়আল নোমানের মরদেহ প্রথমে নেয়া চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশব্বিদ্যালয়ে (সিভাসু), যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল নোমানের। সেখানে
সিভাসু’র শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সিভাসু’র উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ আল নোমান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি এ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন। তাঁর এ অবদান সিভাসু পরিবার কখনো ভুলবে না।’
সেখানে প্রয়াতের সন্তান সাঈদ আল নোমানও বক্তব্য রাখেন। সিভাসুতে প্রয়াত আবদুল্লাহ আল নোমানের স্মরণর একটি শোকবই খোলা হয়েছে।
সিভাসু থেকে নোমানের মরদেহ নেয়া হয় তার প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গনে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এরপর কফিনবন্দি নোমান ফিরেন বিএনপি নেতা হিসেবে তার অর্ধশত বছরের রাজনীতির প্রিয় প্রাঙ্গন নাসিমন ভবনে। নগরীর নুর আহমদ সড়কে দলীয় কার্যালয়ের এ মাঠে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজার, হাজার সভা-সমাবেশ করেছেন নোমান। লাখো কর্মীকে রাজনীতির দীক্ষা দিয়েছেন। সেই প্রাঙ্গনে যখন তিনি শেষবারের মতো এলেন, তখন নেতাকর্মীরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে বরণ করে নিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ মরদেহ গ্রহণ করেন। নগর বিএনপি এবং বিভিন্ন ওয়ার্ড-থানা ও শাখা সংগঠনের পক্ষে নোমানের মরদেহে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘নোমান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনীতি করেছি। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে, আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আমরা একসাথে কাজ করেছি। এই নাসিমন ভবনে পুলিশের আক্রমণ, টিয়ার গ্যাসের শিকার হয়ে আমরা আশ্রয় নিয়েছি।’
“সরকারের ভেতরে, সরকারের বাইরে, রাস্তায় শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন, তার আগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উনার উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমরা উনার অবদানের জন্য ঋণী। নোমান ভাই হয়তো সুস্থ থাকলে, আরও কিছুদিন বাঁচলে আমাদের আগামী রাজনীতিতে বিশেষ করে আজকের যে প্রেক্ষাপট আরেকটি ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসে পড়েছি। এসময় তার অবদান আমাদের প্রয়োজন ছিল।’
এরপর সাঈদ আল নোমান দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের আর কোনো অভিমান আর তার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। রাজনীতিতে অনেক প্রতিযোগিতা ছিল, সেই প্রতিযোগিতাও আর আপনারা আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে করতে পারবেন না। তার নিজেরও কোনো দু:খ, কোনো অভিমান যদি থাকে, সেটা আর আপনারা জানতে পারবেন না। আমি এক অসহ্য তাড়নায় ডুবে আছি। কী করতে পেরেছি সন্তান হিসেবে তার জন্য। আমি আজ এখানে লিখে দিতে পারবো, আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি, আপনারাও আজ নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনাদের যাদের সঙ্গে তার দীর্ঘ পরিচয় ছিল, আপনারা নিজেকে প্রশ্ন করুন- নোমান ভাইয়ের জন্য আমি কী করতে পেরেছি আর নোমান ভাই আমার জন্য কী করেছিলেন।’
‘আমি সন্তান হয়ে যদি এই প্রশ্নের মধ্যে পড়ি, আপনারাও তার সন্তান, কখনো কখনো আপনারা আমার চেয়েও তার বেশি প্রিয় সন্তান ছিলেন। রাজনৈতিক শিষ্যের জায়গা থেকে,রাজনৈতিক সহকর্মীর জায়গা থেকে, রাজনৈতিক সহযোদ্ধার জায়গা থেকে, সন্তান ছিলেন আপনারাই।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে ব্যক্তিচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে কেউ যদি প্রতিষ্ঠানকে সার্বজনীন করার চিন্তা করেন, সেটা একজনই আবদুল্লাহ আল নোমান। সেজন্য অসংখ্য অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের লোকজন, যাদের কথা অন্য কেউ চিন্তাও করতে পারবে না, উনার মৃত্যুর পর থেকে এমন হাজার হাজার মানুষ উনাকে একনজর দেখার জন্য এসেছেন। রাজনীতিতে অপরপক্ষ থাকে, দলের ভেতরও থাকে, বাইরে তো অবশ্যই থাকে। কিন্তু আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর পর গত তিনদিন ধরে যদি সোশ্যাল মিডিয়া ফলো করেন, দেখবেন, লাখো মানুষ, যিনি যে দলই করুক না কেন উনার জন্য একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এমন উদাহরণ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির নেই। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে বলছি, চট্টগ্রামের ইতিহাসে নয়।’
‘যদি মানুষের জন্য কিছু করতে হয়, সর্বোত্তম পন্থা রাজনীতি। আবদুল্লাহ আল নোমানকে সৃষ্টি করেছিল মানুষ। আজ যিনি শুয়ে আছেন, তিনি যেমন অসাধারণ একজন রাজনীতিবিদ, তেমনি একজন অসাধারণ মানুষ। একজন ব্যক্তি আবদুল্লাহ আল নোমান তাই সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে, এমপির ঊর্ধ্বে, মন্ত্রীর ঊর্ধ্বে একজন মানুষ, যার জন্য পুরো চট্টগ্রাম, পুরো দেশ কাঁদছে,’- বলেন সাঈদ আল নোমান।
নাসিমন ভবন থেকে জমিয়াতুল ফালাহ- সবখানেই ছিল শোকার্ত মানুষের স্রোত। জমিয়াতুল ফালাহ ময়দানে জানাজা শেষে নোমানের মরদেহ নেয়া হয় তার জন্মস্থান রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে। গহিরা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আরেক দফা জানাজা শেষে তিনি শায়িত হবেন সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে।
গত ২৫ ফেব্রয়ারি ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ আল নোমানের জীবনাবসান ঘটে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন আবদুল্লাহ আল নোমানের। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকারের গঠিত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে। সেই শুরু সাম্যবাদী রাজনীতির পথচলার। ১৯৬৫ সালে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ আল নোমান ছাত্র ইউনিয়নের মেননপন্থী হিসেবে পরিচিত চীনপন্থী অংশে যোগ দেন। তিনি সংগঠনটির বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
ঊনষত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে নোমান চট্টগ্রামের একজন সামনের কাতারের সংগঠক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি শেষ হলে তিনি যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। এর আগেই অবশ্য তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সংস্পর্শে আসেন। নোমানকে পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি করা হয়। পাশাপাশি ভাসানীপন্থী ন্যাপের রাজনীতিতেও সক্রিয় হন। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আবদুল্লাহ আল নোমান বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাগদলের সঙ্গে ‘ভাসানী ন্যাপ’ একীভূত হয়। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ন্যাপ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান যোগ দেন বিএনপিতে। আমৃত্যু তিনি এ দলের সঙ্গেই ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। আশি-নব্বইয়ের দশক, এর পরবর্তী আরও অন্তঃত এক দশক চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে আবদুল্লাহ আল নোমানকে ঘিরেই।
১৯৯১ ও ২০০১ সালে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। দু’বারই তিনি বিএনপির মন্ত্রীসভার একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি ডবলমুরিং-হালিশহর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এসআর
আবদুল্লাহ আল নোমান চট্টগ্রাম নোমানের শেষ বিদায় বিএনপি বিএনপি নেতা রাজনীতির বরপুত্র লাখো মানুষের শ্রদ্ধা