বসন্তেই গ্রীষ্মের আবহ
রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা ছাড়াবে ১৬ হাজার মেগাওয়াট
১ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ১ মার্চ ২০২৫ ১০:২৪
ঢাকা: শুরু হচ্ছে রমজান মাস। এদিকে বসন্ত বিদায় না নিতেই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে গ্রীষ্ম। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বাড়ানো হচ্ছে কয়লার আমদানিও। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেকটাই নির্ভর করতে হবে এলএনজি ও কয়লার ওপরে।
সরবরাহ পরিস্থিতি
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৩টি। এর মধ্যে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৫৮টি আর সাতটি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর খাতা কলমে উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৪ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ)। যদিও প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৯০৬ মেগাওয়াট। মোট উৎপাদনের ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। আর সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট পাওয়া যায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এ ছাড়া, আমদানি করা হয় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট।
রমজান ও গ্রীষ্ম
২ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রজমান মাস। স্বাভাবিকভাবেই এ মাসে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তি থাকে। তবে সেইসঙ্গে গরম বেশি পড়তে শুরু করলে এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। এদিকে বর্ষপুঞ্জিতে বসন্ত ঋতু হলেও প্রকৃতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে গ্রীষ্ম। রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকলেও দিনের তাপমাত্রা বাড়তি থাকছে।
আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস বলছে, মার্চ মাসে তীব্র গরম অনুভূত হবে। মাসের অধিকাংশ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রায় কোনো পার্থক্য থাকবে না। এতে বোঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে গরম বাড়বে। আর তাতে বাড়াবে বিদ্যুতের চাহিদা। আবার কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে সেচ কাজ। দেশে সেচ সংযোগের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার। সেখানে অতিরিক্ত বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। সব মিলিয়ে গ্রীষ্ম ও রমজান মাস সামাল দিতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
সরকারের প্রস্তুতি
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে অর্থাৎ বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ১১ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু রমজান মাসে বিদ্যুতের চাহিদা আরও চার হাজার মেগাওয়াট বেড়ে যাবে। আর এ চাহিদা সামাল দিতে সরকারকে যেতে হবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন স্তরের কাছাকাছি। যদিও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল।
এবার রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে অতিরিক্ত এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, খোলাবাজার থেকে শুরুতে পাঁচটি এলএনজি কার্গো ক্রয়ের পরিকল্পনা করেছিল। পরে চাহিদা বাড়তে পারে চিন্তা করে আরও একটি কার্গো কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থ বিভাগের কাছে আট হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, নতুন ওয়ার্ক-ওভার করা কূপ থেকে আরও ৬০ থেকে ৭০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করছে পেট্রোবাংলা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমকে সামনে রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে চায় সরকার। সেজন্য এলএনজি আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি কয়লা আমদানিও বাড়ানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্রা মার্চ মাসের জন্য ৩ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
এসি থাকবে ২৫ ডিগ্রিতে
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্তের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে দেশের এয়ার কন্ডিশন (এসি)। কর্মকর্তারা বলছেন, এসির তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নির্ধারণ করলে কমপক্ষে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। আর সেই চিন্তা থেকেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে আসছে রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়ে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিধি শাখা।
অতিরিক্ত সচিব জাহেদা পারভীনের সই করা পরিপত্রে বলা হয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অভীষ্ট তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২৫° সেলসিয়াসে নির্ধারণের পরামর্শ পাওয়া গেছে। এবার রমজান, গ্রীষ্মকাল ও সেচ মৌসুম একই সময়ে শুরু হবে। সেজন্য আসন্ন মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। শীতাতপ থার্মোস্ট্যাট নির্ধারিত তাপমাত্রায় ব্যবহারের মাধ্যমে এ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ অবস্থায়, সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস বা এর উপরে নির্ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত যথাযথ বাস্তবায়ন করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ঘোষণা দেন, আসন্ন গ্রীষ্মে কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ২৫ ডিগ্রির নিচে রেখে এয়ার কন্ডিশন চালাতে পারবে না। তিনি জানান, এ নিয়ম লঙ্ঘন করলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকার আর্থিক সংকটে রয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা আরও বলেন, এ কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির জন্য বিদেশি ঋণদাতাদের অর্থ পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য সরকার বৈদেশিক ঋণ প্রদানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা নিচ্ছে। এ নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম