ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকে তীব্র উত্তেজনা, বাতিল খনিজ চুক্তি
১ মার্চ ২০২৫ ০৯:২৫
হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে অনুষ্ঠিত হয়। এতদিন ধরে এই দুই নেতা পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন, কিন্তু এবার বৈঠকেই তারা সরাসরি বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা, কিন্তু বৈঠকের একপর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এতটাই চরমে পৌঁছায় যে চুক্তিটি বাতিল করতে হয়। শুধু তাই নয়, বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন হওয়ার সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়।
বৈঠকের শুরুতেই ট্রাম্প ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, জেলেনস্কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন। তিনি বলেন, ‘আপনার দেশের মানুষ খুবই সাহসী; কিন্তু আপনাকে হয় (রাশিয়ার সঙ্গে) একটি চুক্তি করতে হবে, নইলে আমরা আর আপনাদের পাশে থাকব না। আর আমরা যদি না থাকি, তাহলে আপনাকে একা লড়তে হবে।’
ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পরপরই জেলেনস্কি পাল্টা জবাব দেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করার পক্ষে যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ‘একজন খুনির সঙ্গে কোনো চুক্তি হতে পারে না। পুতিনের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত নয়।’
জেলেনস্কির এই বক্তব্যের পর ট্রাম্প পালটা জবাবে বলেন, ‘জেলেনস্কি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন। মানুষ মারা যাচ্ছে, সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমছে, আপনার হাতে কোনো বিকল্প নেই। একবার আমরা চুক্তি করলে ইউক্রেন ভালো অবস্থানে চলে যাবে, কিন্তু আপনাকে কৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে না।’
এই উত্তপ্ত বক্তব্য বিনিময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে নির্ধারিত যৌথ সংবাদ সম্মেলন আর হবে না। তার কিছুক্ষণ পরেই জেলেনস্কি ও তার প্রতিনিধি দল হোয়াইট হাউজ থেকে বেরিয়ে যায়।
বৈঠকের পরপরই ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্ট দেন, যেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে, ‘জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও হোয়াইট হাউসকে অসম্মান করেছেন। যেদিন তিনি শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, সেদিন আবার হোয়াইট হাউসে আসতে পারেন।’
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির এই বিতণ্ডার প্রতিক্রিয়ার রাশিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে গিয়ে অনেক মিথ্যা বলেছেন। সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি হলো, ২০২২ সালে কিয়েভ সরকার একা ছিল।’
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ এই ঘটনায় আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে লেখেন, ‘অবশেষে উদ্ধত শূকরটি ওভাল অফিসে উপযুক্ত থাপ্পড় খেয়েছে। ট্রাম্প ঠিক বলেছেন, কিয়েভের শাসনকাঠামো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছে।’
এই উত্তপ্ত বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ট্রাম্পের কড়া অবস্থানের প্রশংসা করেছেন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা এবং তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট ব্যাসেন্ট লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, বিশ্বমঞ্চে আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!’
রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রাল্ফ নরম্যান লিখেছেন, ‘শক্তিশালী নেতৃত্ব নিশ্চিত করছে, আমরা আমেরিকান জনগণকেই এগিয়ে রাখছি।’
অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলো জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছে। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক লিখেছেন, ‘প্রিয় জেলেনস্কি, ইউক্রেনের প্রিয় বন্ধুরা, আপনারা একা নন।’
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সেনচেজ বলেছেন, ‘স্পেন ইউক্রেনের পাশে আছে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, ‘রাশিয়া আগ্রাসনকারী এবং ইউক্রেন এই আগ্রাসনের শিকার। যারা শুরু থেকে লড়াই করছে, তাদের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।’
ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিস শিমহাল বলেছেন, ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া ইউরোপের জন্য যুদ্ধবিরতি হতে পারে না।’
ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকটি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে পরিণত হওয়ায় কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি, বরং দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি হয়েছে। বৈঠকের পর ট্রাম্প যেখানে জেলেনস্কিকে ‘যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মানকারী’ বলে অভিহিত করেছেন, সেখানে ইউরোপের দেশগুলো প্রকাশ্যে জেলেনস্কির সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে।
এতে বোঝা যাচ্ছে যে, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক এখন বেশ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে, এবং এই বৈঠক দুই দেশের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
সারাবাংলা/এনজে