রমজান শুরু, কথা রাখেননি তেল ব্যবসায়ীরা
১ মার্চ ২০২৫ ২১:৫৫
ঢাকা: রোববার (২ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রমজান শুরুর আগেই বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়বে, থাকবে না কোনো সংকট। তারা এখনো বলছেন, রোজায় তেলের সংকট হবে না। অথচ বাজারের চিত্র ভিন্ন। তেলের সরবরাহ তো বাড়েইনি, বরং সংকট আরও প্রকট হয়েছে। অলি-গলির দোকান তো দূরের কথা, বড় বড় বাজারগুলোর অধিকাংশ দোকানে মিলছে না বোতলের সয়াবিন তেল। যে কয়েকটা দোকানে তেলের দেখা পাওয়া গেছে, সেখানেও বোতল প্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
শনিবার (১ মার্চ) রাজধানীর ফার্মগেটে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোট মুদি দোকানগুলোতে এক লিটার, দুই লিটার কিংবা পাঁচ লিটারের বোতলের সয়াবিন তেল নেই। সুপারশপগুলোতেও সয়াবিন তেল দেখা যায়নি। তবে রাইসবার্ন, অলিভওয়েলের মতো ভোজ্যতেল দেখা গেছে, যা স্বল্প কিংবা মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলারদের কাছে অর্ডার দেওয়া আছে, তারা বলেছিলেন রোজা শুরুর আগেই তেলের সরবরাহ বাড়বে। কিন্তু কাল থেকে রোজা শুরু হচ্ছে এখনো আমরা তেল পাইনি।
ফার্মগেট কাঁচা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছি তেলের জন্য। কিন্তু এখনো ডিলাররা তেল দিতে পারেননি। গতকাল (শুক্রবার) মৌলভীবাজার গিয়ে দেখি তেলের দাম অত্যাধিক বেশি। এত বেশি দামে খুচরা বিক্রি করা কঠিন।’ মনিপুরি পাড়ার রেশমা স্টেশনারী দোকানের মালিক রেজাউল করীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তেল নিয়ে ঝামেলা যাচ্ছে না। গত এক সপ্তাহ ধরে তেল নেই দোকানে। কাস্টমার প্রতিদিন তেল চাচ্ছে, কিন্তু দিতে পারছি না। নিজের ঘরেই তেল সংকট।’
এদিকে ক্রেতারা বলছেন, কয়েক দোকান ঘুরে কোথাও তেল পেলেও দাম রাখে অনেক বেশি। মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই। তেল সংকটের এই চিত্র পুরো রাজধানী জুড়ে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তেলের এই পরিস্থিতি পুরা ফেব্রুয়ারি জুড়েই। এ সপ্তাহে যেন আরও বেশি সংকট দেখা যাচ্ছে।
দেশে ভোজ্যতেলের বাজার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পামঅয়েল ও সয়াবিন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে পাম অয়েল পরিশোধিত অবস্থায় এনে বিপণন করা হচ্ছে। অন্যদিকে সয়াবিন তেল অপরিশোধিত অবস্থায় এনে দেশে পরিশোধন করে বিপণন করা হয়। আর এর আমদানিকারক দেশের চার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো- এস আলম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টি কে গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপ।
ভোজ্য তেলের বাজারের সিংহভাগ পাম অয়েলের দখলে থাকলেও বাসা বাড়িতে বোতলের সয়াবিন তেলের চাহিদাই বেশি। কিন্তু রমজানের সময়ে এই চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যায়। গেল বছরের সঙ্গে চলতি বছরের এই সময়ের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গেল বছর বাজারে তেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও দাম বেড়েছিল অস্বাভাবিক। এ বছর বাজারে তেল নেই; তার পরেও যা পাওয়া যাচ্ছে, দাম অত্যাধিক। আর এটা এবারের রমজানের বাজারের সবচে বড় অস্থিরতা বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।
ব্যাংক কর্মকর্তা রিয়াজুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, ‘তেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রেখে দাম কিছুটা বাড়ালেও মানা যায়। কিন্তু এবার তো তেলই নেই। আমি যে পয়সা খরচ করে প্রয়োজন মেটাব সেই সুযোগই তো নেই।’ স্কুল শিক্ষক মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা মনিপুরি পাড়া বাজারে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘কাল থেকে রোজা শুরু। আপনারা জানেন, ইফতার তৈরির প্রধান অনুষঙ্গ তেল। সেই তেল যখন না থাকে তখন কেমন পরিস্থিতি হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাসে পাঁচ লিটার তেল প্রয়োজন হয়। গেল মাসে তিন লিটার তেল দিয়ে মাস শেষ করেছি। বিষয়টা সরকার যদি এখনো নজরে না নেয় তাহলে অস্থিরতা আরও বাড়বে।’
এদিকে গত তিন দিন আগেও ভোজ্যতেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রোজার আগেই তেলের বাজারে স্বস্তি ফিরবে। সরবরাহ বাড়বে তেলের। তেল আমদানিকারক টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রমজানকে সামনে রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন। সেসব তেল কিন্তু আসতেও শুরু করেছে। আমাদের গ্রুপেরও জাহাজ চট্টগ্রামে ভিড়েছে। খালাস হচ্ছে তেল। তবে আরও তেল আসার অপেক্ষায়।’ দুই দিন আগে তিনি সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমরা বলেছিলাম ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ একটু হ্যাসেল যাবে। রমজান থেকে সরবরাহ বাড়বে এবং রোজায় তেল সংকট থাকবে না।’
এ ছাড়া ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিল, ‘পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। তাই এই সময়ে সংকটের আশঙ্কা নেই।’
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। মাসিক চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন। আর মাসে সয়াবিন তেলের গড় চাহিদা ৭৯ থেকে ৮৭ হাজার টন।
এদিকে গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (মাসের হিসাবে) সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। একইসঙ্গে তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিন বীজ আমদানিও ছিল ৩১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমদানি হওয়া এই তেল প্রক্রিয়াজাত শেষে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বাজারে আসার কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি।
যদিও এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের একাধিক কমিটি কাজ করছে। তারপরেও কাটছে না ভোজ্য তেলের সংকট।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম