Tuesday 11 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রিমান্ডে রাজনীতিকরা
পুলিশ পালটে গেল নাকি সিস্টেম?

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ৩ মার্চ ২০২৫ ১০:২৪

রিমান্ডের সেকাল-একাল। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ‘রিমান্ড’ শব্দটি মানুষের কাছে ভয়াবহ এক আতঙ্কের নাম। মানুষের ধারণা- রিমান্ড মানেই নির্যাতন। অবশ্য এমন ধারণা হওয়ার পেছনে কারণও আছে। বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষ রাজনীতিক থেকে শুরু করে যাদের কণ্ঠ উচ্চকিত তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর উদাহরণ নতুন নয়।

অভিযোগ রয়েছে, জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পতনের আগ পর্যন্ত বিরোধীপক্ষকে দমনের জন্য রিমান্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো। নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই যে কাউকে ধরে নিয়ে রিমান্ডের নামে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো। এই নির্যাতনের অন্যতম শিকার ছিলেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পরবর্তী সময়ে যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও আসে।

বিজ্ঞাপন

ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারায় রিমান্ডের কথা বলা হলেও ওই কার্যবিধির কোথাও রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কোনো আসামিকে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার ফেরত নেওয়াকে বুঝায় রিমান্ড।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর গত ছয় মাসে গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগ সরকারের ৩৬ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ৪৩ জন এমপি এবং কয়েকডজন অন্যান্য নেতাকর্মী। এদের মধ্যে কেবল সাবের হোসেন চৌধুরী ও এম এ মান্নান জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তবে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই বর্তমানে জেলে আছেন এবং বিভিন্ন মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। যদিও রিমান্ডের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মীদের আদালতে তোলা হলে তাদের খুবই হাস্যোজ্জ্বল ও সুস্থ দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবর্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ মনে করছেন- পতিত সরকারের নেতাকর্মীদের রিমান্ডে নেওয়ার পর শুধু সময় পার করে তাদের আদালতে তোলা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতন করা হতো। রিমান্ডের পর তাদের কাউকে কোলে করে, আবার কাউকে হুইল চেয়ারে আদালতে তোলা হতো। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত ও ছাত্রশিবির নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও দেলোয়ার হোসাইন, ঢাবির সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর এবং ধর্মীয় নেতা মামুনুল হক। রিমান্ডে তাদের ওপর চালানো নির্যাতনের ভয়াবহতা বিশ্ব গণমাধ্যমেও উঠে আসে।

অথচ এখন রিমান্ড শেষে বিরোধীপক্ষের রাজনীতিকদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা মিডিয়ায় উঠে আসছে। দুই শাসনামলের রিমান্ডের এই দ্বিচারিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন- তবে কি পাল্টে গেছে পুলিশের মানসিকতা? রিমান্ডে এখনো আওয়ামী লীগের প্রভাব বিরাজমান, তাই রিমান্ডে নিয়ে শুধুই সময় পার করছে পুলিশ? নাকি প্রশাসনের ভেতরে ব্যাপক আওয়ামী লীগের লোকজন রয়েছে? এভাবেই কি তাহলে আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাদের হাসি দেশের মানুষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে?

আওয়ামী লীগের আমলে রিমান্ড পরবর্তী চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগের আমলে রিমান্ড পরবর্তী চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে বিষয়টি ভিন্নভাবেও দেখছেন অনেকে। তাদের মতে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর নতুন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে কেউ অন্যায়ের শিকার হবে না। কারও ওপর অত্যাচার করা হবে না। আওয়ামী লীগ সরকার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে তার স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ করতো। অন্তর্বর্তী সরকারও পতিত সরকারের মতো আচরণ করলে তো কারও মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। রিমান্ডে নির্যাতনের চিত্র এখন উল্টো দিকে ঘুরে গেলে এগুলো নিয়ে সমালোচনা তৈরি হবে বলে সাবধানে এগোচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পতিত সরকারের সময় পুলিশের মানসিকতা কঠোরভাবে দমন করা হতো। ভালো-মন্দ সবধরনের অফিসার ছিলেন। যারা ভালো সবসময় তাদের পিছিয়ে রাখা হতো। এমনকি তাদের প্রমোশনও আটকে থাকতো। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর যে যত অত্যাচার নির্যাতন চালাতো তার প্রমোশন দ্রুত হয়ে যেত। অনেকে আবার প্রমোশনের লোভে এবং চাকরি বাঁচাতে রিমান্ডে আসামির ওপর নির্যাতন চালাতো। সেই নির্যাতন থেকে তারেক জিয়া, বাবর ও জামায়াতের সিনিয়র নেতারাও বাদ যাননি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশের ওপর অন্যায়ভাবে কিছু করার জন্য চাপ আসছে না এবং দেখছিও না।’

গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান ২০১৩ সালে বিশেষ অভিযান চালিয়ে শিবিরের ঢাকা মহানগর পশ্চিমের ২৭ নেতাকর্মীকে আটক করেন। এর পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তৎকালীন শিবিরের ঢাকা পশ্চিমের সভাপতি সাজ্জাদ ও সেক্রেটারি গোলাম কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিমান্ডের সময় তিনি আমাদের বলতেন আমি জারজ, আমার কোনো দয়ামায়া নাই। আমাদের পা বেঁধে উপরে সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে। সেই ঝুলন্ত অবস্থাতেই জ্ঞান চলে যেত। জ্ঞান ফিরলে দেখতাম ঝুলন্ত অবস্থাতেই আছি। ইলেকট্রিক শক দেওয়ায় অনেকের রক্ত বমি ও প্রসাবের সঙ্গে রক্ত যেত। প্লাস দিয়ে আমাদের কয়েকজনের হাতের নখও তুলে ফেলা হয়। ভয়াবহ সেই নির্যাতনের সময় আমারা ভাবতাম, এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো।’

২০১২ সালে রাজধানীর মতিঝিল থানায় আটক হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ। সারাবাংলাকে তিনিু বলেন, ‘পুলিশের ওপর নির্দেশ ছিল কিছু লোককে সেই সময়ে আটক করতে হবে। সেজন্য আমিসহ আরও কিছু তরুণকে সেদিন আটক করা হয়। এরপর পাঁচদিন রিমান্ডে নিয়ে অন্যায়ভাবে মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। আমরা যেন বলি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছি, সেটা তারা স্বীকার করাতে চেয়েছিল।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিমান্ড শুনলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। রিমান্ডে নির্যাতন আইনবহির্ভূত। আবার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিধিগতভাবে কাউকে ছাড় দেওয়া বা বিধিবহির্ভূতভাবে নির্যাতনের অভিযোগ- সেটি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি করে এবং রিমান্ডের যে প্রয়োজন সেটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।’

তিনি বলেন, ‘রিমান্ডের নামে নির্যাতন হবে সেটি আমরা প্রত্যাশা করি না। আবার রিমান্ডে তথ্য বের করার বিধিগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে না সেটিও অপ্রত্যাশিত। রাজনৈতিকভাবে যে মামলাগুলো হয় সেখানে আইশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। অন ইলেভেনের সময় বহু বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। যেগুলোর স্পষ্ট কোনো বক্তব্য আইশৃঙ্খলাবাহিনী এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি। তাদের বুঝতে হবে, তারা যেন রাজনৈতিকভাবে কাউকে হয়রানি, নির্যাতন বা নিপীড়ন না করে। আইশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিয়ম বিধির মধ্যে থেকে এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে উপায়গুলোর কথা সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে, সেই উপায়গুলোই যে সবসময় প্রয়োগ হয় ব্যাপারটি সেরকম নয়। আবার রিমান্ড সম্পর্কে আইন বা বিধিগতভাবে পুলিশ যা বলে সেটাই যে তারা করে বিষয়টি তেমনও নয়। রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে আমরা দেখে থাকি যে, এর পেছনে আক্রোশ থাকে। ১/১১ এর সময়ে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের আদালতে তোলার সময় যে ধরনের বাস্তবতা দেখা গেছে, সেই বাস্তবতা যে সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ব্যাপারটি তেমনও না। এখন কাউকে আমরা দেখছি হাস্যোজ্জ্বল, আবার কেউ কথা বলতে বলতে আদালতে যাচ্ছেন। রিমান্ড প্রয়োগে পরিবর্তনের জায়গাটি এমনভাবে আনতে হবে যেন একটি নিয়ম বা কাঠোমোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়।’

সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের ভেতর মানসিক পরিবর্তন এসেছে কিনা? জানতে চাইলে ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘কিছুটা এসেছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, সেগুলোর পুরোটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের পরিবর্তন এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনটা তারা সময়ের সঙ্গে মিল রেখে, নাকি সত্যিকার অর্থেই করছে সেটা আরও কিছুদিন গেলে পরিমাপ করা যাবে।’

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

একাল পুলিশ রাজনীতিক রিমান্ড সেকাল