Tuesday 01 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহরজুড়ে ‘ইফতারির হাট’, রাজকীয় আয়োজন অভিজাত রেস্তোঁরায়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৩৫ | আপডেট: ৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৫৫

রোদেলা বিকেলে বাহারি ইফতার নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে ‘ইফতার বাজার’। ছবি: সারাবাংলা/শ্যামল নন্দী

চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্টেডিয়াম পাড়ার ‘রোদেলা বিকেল’। খাবারে বৈচিত্র্য আর মানের কারণে গ্রাহকদের কাছে রেস্তোঁরাটির গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। এবার রমজানে প্রতিদিন ৪০ পদের ‘রাজকীয়’ ইফতার আয়োজন করছে রোদেলা বিকেল। বরাবরের মতো শুরুর দিন থেকেই সাড়া ফেলেছে রেস্তোঁরাটি।

নগরীর জিইসি মোড়ের অভিজাত হোটেল পেনিনসুলা চিটাগং, রমজানে মজার মজার ইফতার আয়োজন নিয়ে সুখ্যাতি আছে তাদেরও। দেশি পদের পাশাপাশি বিদেশি বৈচিত্র্যময় নানা খাবারের সমাহার ঘটিয়ে তারা প্রতিদিন আয়োজন করে চলেছে ‘রমজান ইফতার ফিস্ট’। নগরীর পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লু বে ভিউ বাহারি পণ্য নিয়ে আয়োজন করেছে ‘ইফতার বাজার’।

বিজ্ঞাপন

পিছিয়ে নেই বন্দরনগরীর বনেদি রেস্তোঁরাগুলোও। যেমন- বোম্বাইওয়ালার দোকান খ্যাত নগরীর এনায়েত বাজারে ‘রয়েল বাংলা সুইট হাউসের’ জিলাপি ও হালিম কিংবা চকবাজারে ফকির কবিরের দেশি সেমাই। আর নগরজুড়ে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো তো আছেই ইফতার বিক্রির পসরা নিয়ে।

রোদেলা বিকেলের ৪০ পদের মধ্যে আছে- দেশি চিকেন হালিম, মাটন হালিম, মেজবানের গরুর মাংস, মিহিদানা, জিলাপি, লাচ্ছা জিলাপি, পাটিসাপটা পিঠা, কিসমিস ফিরনি, স্পেশাল পরোটা, দেশি চিকেন তান্দুরি, চিকেন তান্দুরি, চিকেন চাপ, চিকেন ললিপপ, বিফ বটি কাবাব, প্রণ তন্দুরি, ফিশ ফিঙ্গার, বিফ কাচ্চি ও আকনি বিরিয়ানি, মাটন কাচ্চি বিরিয়ানি, মাটন পায়া, চিকেন মোমা, চিকেন শর্মা, বিফ এগ রোল, চিকেন এগ রোল, ফিশ টিক্কা কাবাব, টক দই, মিষ্টি দই, ম্যাংগো লাচ্ছি, গরুর নলা, চিকেন শামী কাবাব, সুজির হালুয়া, ঘিয়ে ভাজা লুচি, চিটা পিঠা, চিকেন আলুর চপ, চিকেন সাসলিক, ওরশের বিরিয়ানি, মাটন চুইঝাল, মাটন লেগ কোরমা এবং দেশি মোরগ মাসাল্লাম।

বিজ্ঞাপন

ইফতার নিতে আসা ক্রেতাদের জটলা রয়েল বাংলা সুইট হাউসের সামনে। ছবি: সারাবাংলা/শ্যামল নন্দী

আবার রেস্তোঁরাটিতে প্রতিদিন দুই ধরনের প্যাকেজও পাওয়া যাচ্ছে। ৫২০ টাকার প্যাকেজে আছে- খেজুর, চনা, পেঁয়াজু, বেগুনি, জাফরান মিল্ক জিলাপি, আনারসের জুস, মেজবানের গরুর মাংস, তান্দুরি চিকেন পরোটা, কুমিল্লার মুড়ি, চিকেন আলুর চপ ও মিনারেল ওয়াটার। ৮২০ টাকার প্যাকেজে আছে- আবুধাবির খেজুর, চনা, পেঁয়াজু, বেগুনি, চিকেন মোমো, কিসমিস ফিরনি, জাফরানি মিল্ক জিলাপি, প্রিমিয়াম হালিম চিকেন অথবা মাটন, সুইট লাচ্ছি, কুমিল্লার মুড়ি, চিকেন এগ রোল, চিকেন আলুর চপ ও মিনারেল ওয়াটার।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১২ বছর ধরে এভাবেই ইফতারের আয়োজন করে আসছি। একটি বিষয় আমরা সবসময় প্রাধান্য দিই, সেটা হচ্ছে- আমরা কোয়ালিটির সঙ্গে কখনও কম্প্রোমাইজ করি না। ইফতার তৈরিতে আমরা ব্যবহার করছি ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডের অলিও অরলিও ব্র্যান্ডের সানফ্লাওয়ার তেল, সিঙ্গাপুরের চিনি, কোরিয়ার ময়দা, কাশ্মিরের জাফরান, নিউজিল্যান্ডের বাটার অয়েল। দেশি উপকরণের মধ্যে আমরা খাঁটি গাওয়া ঘি ব্যবহার করে। প্রতিদিনের আইটেম প্রতিদিন বিক্রি করে ফেলি।’

রাজকীয় ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে রোদেলা বিকেলে। ছবি: সারাবাংলা/শ্যামল নন্দী 

‘কোয়ালিটির কারণে ১২ বছর আগে শুরুতে যে কাস্টমার আমাদের কাছ থেকে ইফতার কিনেছেন, ১২ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে তিনি রমজানের প্রথমদিন থেকেই হাজির। ঢাকা থেকে এসে ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের তারকা মানের হোটেলে উঠেছেন, দেখা যাচ্ছে, তিনি ইফতার করছেন রোদেলা বিকেলে এসে। এটা সম্ভব হয়েছে কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ না করার কারণে। আমরা রান্নার সময় তদারকিটা খুব শক্তভাবে করি। আর কেউ অভিযোগ করলে সেটার যৌক্তিকতা বিবেচনা করে গ্রাহকের সামনেই ব্যবস্থা নিই,’ – বলেন শামসুদ্দিন।

একযুগ ধরে রোদেলা বিকেল থেকে ইফতার কিনে আসা খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহেদের সঙ্গে সোমবার দুপুরে ওই রেস্তোঁরায় দেখা হয়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একটা ভয় আছে যে, রেস্টুরেন্ট থেকে ইফতার কিনে খেলে বোধহয় পেট খারাপ হবে, স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ না। কিন্তু আমি রোদেলা বিকেলের ইফতার আর ঘরে বানানো ইফতারের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাইনি। আমি রমজানের ত্রিশ দিন এখান থেকেই ইফতার কিনি।’

পেনিনসুলার ‘রমজান ইফতার ফিস্টে’ আছে শতাধিক পদ। তৈরি করছেন পেনিনসুলার এক্সিকিউটভ শেফ মিলরয় নানায়াক্কারা ও তার পেশাদার টিম।

কোফতা কাবাব, হালিম, আস্ত তন্দুরি চিকেন, বিফ তেহারি, জিলাপি, বাসবউসা, খেজুর পুডিংয়ের মতো পদ যেমন আছে, পটেটো মোজারেলা স্টিকস, কর্ন ফ্লেক্স ক্রাস্টেড চিকেন, মেক্সিকান চিকেন অ্যাঞ্জেল পিৎজা, হানি বি বিবিকিউ চিকেন স্কেভারস, টেংরি কাবাব, স্কচবেল কাবাব, বেগেফেবল, বেগফেল, মেক্সিকান চিকেন পিৎজার মতো সুস্বাদু আইটেমও আছে।

পেনিনসুলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১২০০ টাকায় ইফতার টেকওয়ে বক্স মিলছে পেনিনসুলায়। হোম ডেলিভারির জন্য ফুডপান্ডা এবং পাঠাও’র মাধ্যমে অনলাইন অর্ডারের সুবিধা আছে।

রয়েল বাংলা সুইট হাউস। ছবি: সারাবাংলা/শ্যামল নন্দী

এছাড়া ১০৫০ টাকায় ট্র্যাডিশনাল প্ল্যাটার, ১৪০০ টাকায় কন্টিনেন্টাল প্ল্যাটার এবং ১৭৫০ টাকায় পেনিনসুলা প্ল্যাটার- এ তিনটি প্যাকেজ পেনিনসুলার অভ্যন্তরীণ আউটলেটে বসে উপভোগ করতে পারছেন গ্রাহকরা। ২৩০০ টাকায় ওজন প্ল্যাটার উপভোগ করা যাচ্ছে পেনিনসুলার ওজন লাউঞ্জে। দেড় হাজার টাকা থেকে শুরু করে করপোরেট ইফতার বক্স এবং ৯৫০ টাকা থেকে ব্যাঙ্কুয়েট ইফতার প্যাকেজের সুবিধা দিচ্ছে পেনিনসুলা।

পেনিনসুলার লেগুনা এবং সিরাস স্কাই ডাইনিংয়ে জনপ্রতি ৪২০০ টাকায় ইফতার ও ডিনার বুফে উপভোগ করতে পারবেন গ্রাহকরা। এছাড়া সেহরির জন্য লেগুনা রেস্টুরেন্টে মাত্র দুই হাজার টাকায় স্পেশাল বুফে আছে।

পেনিনসুলা হোটেলের ব্যবস্থাপক (সেলস এন্ড মার্কেটিং) কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পেনিনসুলার ইফতার নিয়ে প্রতিবছরই গ্রাহকদের বিশেষ আগ্রহ থাকে। কারণ আমাদের এখানে খাবারে বৈচিত্র্য থাকে। দেশি-বিদেশি খাবারের সমাহারের কারণে পেনিসুললার ইফতারের চাহিদা বেশি। এবারও রমজানের শুরু থেকেই আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’

রেডিসন ব্লু বে ভিউ হোটেলের মাসব্যাপী ‘ইফতার বাজার’- এ আছে ৪১ পদের মুখরোচক খাবার। এতে আছে- ১০৯৫ টাকায় ৫০০ গ্রাম বিফ আখনি, ১৩৯৫ টাকায় ৫০০ গ্রাম মাটন তেহারি, ৯৯৫ টাকায় চিকেন তেহারি, ৩৯৫ টাকা চিকেন চাপ, ৩৭৫ টাকায় বারবিকিউ চিকেন, ৪৫ টাকায় ২ পিস বেগুনি, ২৯৫ টাকায় চিকেন আফগানি কাবাব, ৩৪৫ টাকায় ফ্রাইড ফিশ কাটলেট, ১৯৫ টাকায় মাশরুম তান্দুরি, ২২৫ টাকায় ফ্রাইড ফালাফেল, ৫৯৫ টাকায় ল্যাম্ব আদানা কাবাব, ১০৯৫ টাকায় গুলাব জামুন, ১২৯৫ টাকায় স্পেশাল রেশমি জিলাপি, ৮৯৫ টাকায় এক কেজি ফিরনি, ৯৫ টাকা বাকরহানি, ৮৭৫ টাকায় এক কেজি মাটন হালিম, ৮২৫ টাকায় এক কেজি বিফ হালিম, ৭২৫ টাকায় এক কেজি চিকেন হালিমসহ আরও নানা পদ।

রমজানের শেষদিন পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ইফতার বাজার উন্মুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন রেডিসনের কর্মকর্তারা।

ঐতিহ্যবাহী ‘রয়েল বাংলা সুইট হাউস’ ৪৪০ টাকায় প্রতিকেজি জিলাপি, ৭০০ টাকায় চিকেন হালিম আর ৯০০ টাকায় মাটন হালিম বিক্রি করছে। তাদের দোকানের এ তিনপদের চাহিদা রমজানে থাকে সর্বাধিক। শহরের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে গ্রাহক রোজার দিনে এনায়েত বাজার মোড়ের দোকানটিতে ভিড় জমায়।

এবারের রমজানেও গত দুইদিন এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। দুপুর হওয়ার আগেই মোটর সাইকেল, অটোরিকশা, প্রাইভেট কারে করে আসা ক্রেতার জটলা দোকানটির সামনে। নগরীর এনায়েত বাজারে বাসিন্দা মেহরাজ আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে রমজানের ইফতার মানেই বোম্বাইওয়ালার দোকানের জিলাপি আর হালিম। এই দোকান যে যুগ, যুগ ধরে তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে, সেটা রমজানে সুস্বাদু আইটেমের জন্য। মানুষ সারাদিন রোজা রেখে ভিড় ঠেলে এখান থেকে জিলাপি আর হালিম কেনেন। এই শহরে শত, শত পরিবার আছে, যাদের ইফতারের মেন্যুতে বোম্বাইওয়ালার দোকানের আইটেম লাগবেই।’

চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারে প্রায় ৯০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ‘ফকির কবিরের বেকারি’র দেশি সেমাইয়ের কদর শুরু হয়ে গেছে রমজানের আগ থেকেই। রমজান ঘিরে সেমাইয়ের চাহিদা সামাল দিতে এ বেকারিতে তাদের নিয়মিত অন্যান্য আইটেম তৈরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশি সেমাই বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২৪০ টাকা দরে।

রয়েল বাংলা সুইট হাউসের জিলাপি। ছবি: সারাবাংলা/শ্যামল নন্দী

ফকির কবিরের বেকারি থেকে সেমাই সংগ্রহ করা সাংবাদিক মহসীন কাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই বেকারির সেমাইয়ের স্বাদ চমৎকার। এজন্য বছরের পর বছর ধরে সেমাইয়ের এত চাহিদা। ইফতারিতে তো বটে, ঈদের জন্যও সেমাই কিনি এই বেকারি থেকে। অনেক নামীদামী ব্র্যান্ডের থেকেও ফকির কবিরের সেমাই বেশি সুস্বাদু।’

এদিকে নগরীর জিইসি মোড়, ওয়াসা মোড়, দেওয়ানহাট, খুলশী, বহদ্দারহাট, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, আগ্রাবাদসহ পুরো শহরজুড়ে যেন ইফতারির হাট বসেছে। বিভিন্ন রেস্তোঁরার সামনে প্যান্ডেল সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা, আবার ভ্রাম্যমাণ দোকানেও ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকে। রমজানের সাধারণ ইফতার সামগ্রী ছোলা-মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, শরবত, জিলাপি তো আছেই, শিক কাবাব, শামি কাবাব, কাঠি কাবাব, চিকেন ফ্রাই, চিকেন চাপ, বুন্দিয়া, রকমারি হালিম, চিকেন তেহারি, নানা পদের শরবতও মিলছে এসব দোকানে।

সারাবাংলা/আরডি/ইআ

ইফতার চট্টগ্রাম রোদেলা বিকেল