রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট: ইউরোপের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজি
৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৫৩ | আপডেট: ৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৫৮
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া একটি রাজনৈতিক ও পরবর্তীতে সামরিক সংঘাত সমাপ্তির দিকে এগোতে এগোতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তন রাশিয়ার বিজয়ের পক্ষে ঝুঁকছে। নতুন নির্বাচিত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের সাথে সাথে আমেরিকানরা রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলেছে, যা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। ইউক্রেনকে অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহের পক্ষে যে গতি ও পরিবর্তন ছিল, তা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে এবং আমেরিকানরা এখন তাদের ট্যাক্সদাতাদের টাকা ফেরত চাইছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনকে সাহায্য করতে এখনও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইউরোপীয় নেতারা তাদের ঐতিহাসিক মিত্রদের থেকে একা হয়ে পড়েছেন। ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি’র মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক অত্যন্ত বাজেভাবে শেষ হওয়া আর যৌথ সংবাদ সম্মেলন বাতিল হওয়ায় বিষয়টা আরো জটিল হয়ে গেলো।
যুদ্ধের ফলাফল কী? বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তবে মনে হচ্ছে ইউরোপীয়রা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং এর স্পষ্ট প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো: ইউরোপের মানুষ ক্লান্ত এবং তারা আর মনে করে না যে, একটি হেরে যাওয়া যুদ্ধ আর সংঘাতের জন্য অর্থায়ন তাদের কোনোভাবে সাহায্য করবে। তাই, ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী নেতাদের একটি ঢেউ উঠছে এবং মানুষ ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছে।
অনেকে ইউক্রেনে জড়িত হওয়াকে দায়ী করেন, যা ইউরোপীয় দেশগুলোকে রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেছে, যার ফলে তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। মার্সিডিজ বা ভক্সওয়াগেনের মতো জার্মানির বড় কোম্পানিগুলো হাজার হাজার চাকরি কাটছাঁট করছে কারণ তারা উচ্চ জ্বালানি মূল্যের সাথে সম্পর্কিত খরচ বহন করতে পারছে না: এটি গত ২০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবার ঘটছে।
ইউরোপের শক্তিশালী শিল্প হিসেবে পরিচিত অটোমোটিভ সেক্টর রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে নিষেধাজ্ঞাগুলো আসলে উল্টো ফলাফল দিয়েছে: রাশিয়াতে মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার উচ্চ থাকলেও ইউরোপজুড়ে সামাজিক সংকট ও ব্যাপক চাকরি কাটছাঁট নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইউরোপীয় সমাজগুলি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে এমন একটি মহাদেশে যা ইউরোপীয় নীতিগুলো রক্ষায় সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের জন্য পরিচিত ছিল।
অনেক দেশের তরুন আর উদীয়মান নেতারা ইউক্রেনে পরিচালিত নীতির নেতিবাচক প্রভাবের তীব্র সমালোচনা করেছেন: হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া হলো দুটি দেশ যারা প্রধানত এই সংঘাতের বিরোধিতা করেছে এবং এটিকে স্পষ্টভাবে ‘পাগলামি’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনেকে উত্থাপন করছেন যে, ইউরোপীয়দের জন্য এই বাজি কি খুব দরকারি ছিল? এই সংঘাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর এখনও সম্পূর্ণভাবে দেওয়া যায় না, যদিও সংঘাতের সমাধান দুটি প্রধান পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যারা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া, যা ইউরোপীয়দের সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে তাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ঠেলে দিয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি দেখায় যে, ঝড়ের মধ্য দিয়েও সবসময় মিত্র ও শত্রু দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল মঞ্চে ফিরে এসেছে এবং গ্লোবাল সাউথের আরও বেশি একীকরণের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিশ্ব ধীরে ধীরে একক মেরু থেকে বহুমেরু পর্যায়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলিকে নিকট ভবিষ্যতে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সুযোগগুলি বাড়ছে এবং পশ্চিমা বিশ্ব আর উদীয়মান শক্তিগুলোকে উপেক্ষা করতে পারছে না। একসময় যা কল্পনা ছিল, তা এখন বাস্তব হতে হতে পারে: বাংলাদেশ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নতুন বহুমেরু বিশ্বের সাথে একীভূত করতে পারে, যা সহযোগিতা, বিবেচনা ও সমস্ত পক্ষের প্রতি সম্মানকে উৎসাহিত করে যারা সমস্যা সমাধান ও একসাথে কাজ করতে ইচ্ছুক।
এই সংঘাত কিছুটা হলেও বাংলাদেশের জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ এনে দিয়েছে যদি বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী অংশীদারদের সন্ধান এবং তাদের সাথে কাজ করতে চায়, বাংলাদেকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে চায় এর নাগরিকদের জন্য ও সারা বিশ্বের জন্য, যদিও যুদ্ধের ব্যপাক ক্ষয়ক্ষতি রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের জন্য সে সুযোগ এখনো পুরোপুরি আসেনি, আশার কথা হলো বাংলাদেশ চাইলে সে সুযোগ তৈরী করে নিতে পারে তার আন্তর্জাতিক ও কুটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে।
লেখক: বাংলাদেশী-স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত ফরাসী নাগরিক ও আইনজীবী
সারাবাংলা/এএসজি