Tuesday 04 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত-বিএনপি সম্পর্ক কোন পথে

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৪ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ৪ মার্চ ২০২৫ ০৩:২৯

ভারত-বিএনপি সম্পর্ক। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিএনপিসহ ছোট-বড় ৬৩টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নির্বাচন বর্জনের পর ‘একতরফা ডামি’ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে সম্প্রতি জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। কিংকর্তব্য বিমূঢ় বিএনপির বেশিরভাগ নেতা তখন কারাগারে। সঙ্গত কারণেই তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে কিছুটা ভাটার টান পড়ে। রাজনীতি থেকে অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায় দলটি।

তবে, হঠাৎ করেই মার্চের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। দলটির তখন পরিষ্কার অভিযোগ ছিল ‘একতরফা ডামি’ নির্বাচন আয়োজন ও সরকার গঠনে সরাসরি সহযোগিতা করেছে ভারত। সুতরাং ভারতের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়। তাদের পণ্য বর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই বার্তা দেওয়া যে, নিকট প্রতিবেশি হিসেবে তোমাদের সম্পর্ক করতে হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে নয়।

বিজ্ঞাপন

ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০ মার্চের শীতবিহীন দুপুরে নিজের গায়ের ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে আলোচনার জন্ম দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। কিন্তু, এ ঘটনার ঠিক দু’দিন আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রতিবেশি ভারতের সহযোগিতা কামনা করেন।

২০ মার্চ চাদর পোড়ানো এবং ১৮ মার্চে ভারতের সহযোগিতা কামনার এই বৈপরীত্যের মধ্যেই বিএনপির ভারত ইস্যু থেমে থাকেনি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে রুহুল কবির রিজভী যখন ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় পবিত্র মাহে রমজানের কূটনৈতিক ইফতারে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকদের নিয়ে পাঁচতারকা হোটেলে ইফতার করছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান আরও জোরালো হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দলটির নেতারা অংশ নিয়ে ভারতবিরোধী অবস্থান পরিষ্কার করেন। ৫ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রিজভী তার স্ত্রীর দেওয়া ভারতীয় শাড়ি রাস্তায় ফেলে দিলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন নেতা-কর্মীরা।

আগারতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত ওই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে রিজভী বলেন, “যারা আমার দেশের পতাকাকে নামিয়ে ছিঁড়ে দেয়, আমরা তাদের দেশের পণ্য বর্জন করব। আমাদের মা-বোনেরা তারা আর ভারতীয় শাড়ি কিনবে না। তারা ভারতের সাবান কিনবে না, তারা ভারতের টুথপেস্ট কিনবে না, তারা ভারতের কোনো কিছু কিনবে না।”

এদিকে ভারতের আগরতলা অভিমুখে ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর লংমার্চ করে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন— জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। মূলত আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এই লং মার্চ করে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো।

এর কিছু দিন পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ছবি ভাইরাল হয়। সেই ছবিতে দেখা যায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অতিম অনিলচন্দ্র শাহ’র সামনে নত হয়ে কুশলাদী বিনিময়ের চেষ্টা করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তবে সোফায় আয়েশ করে বসে থাকা অমিত শাহ’র সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

এসব বিপরিতমুখী ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভারত ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানই বা কী? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তদের দেওয়া তথ্যমতে, মূলত গতবছর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় ভারতের ব্যাপারে হার্ডলাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির নীতিনির্ধরকদের একটি অংশ। তাদের নির্দেশেই ভারতবিরোধী কর্মসূচিতে সক্রিয় হন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর রুহুল কবির রিজভী ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগারপূর্ণ বক্তব্য ও মন্তব্য করতে শুরু করেন। ওই বছর ২৬ নভেম্বর অবরোধ চলাকালে ১, ২২, ২৪ ও ২৬ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য সরাসরি ভারতকে দায়ী করেন তিনি। তার এই বিরোধিতা এখনো অব্যাহত আছে।

কিন্তু, রিজভীর এই ভারতবিরোধী অবস্থান বিএনপির বিদেশনীতির সম্পূর্ণ প্রতিফলন নয় বলে জানা গেছে। দলটির স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্য বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সহিষ্ণু ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার পক্ষে। বিশেষ করে নিকট প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে সরাসরি কোনো বিরোধে জড়াতে চান না তারা। বরং ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারতকে পাশে চান। এ কারণেই ঢাকায় যখন রিজভী ভারতীয় শাড়িতে আগুন দেন, গায়ের চাদর খুলে পুড়িয়ে দেন, দিল্লিতে তখন অমিত শাহ’র সঙ্গে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত থাকেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চান ড. মঈন খান।

জানা গেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল বিএনপি। ২০২২ সালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে একান্তে আলাপ করেন বিএনপির একাধিক নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী গতবছর ১৬ মার্চ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির পাঁচ নেতাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। এর পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দু’জন সদস্য দিল্লিতে গিয়ে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে দিল্লিতে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেই সফরের একটি ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পর গুঞ্জন ওঠে ক্ষমতার পালাবদল প্রশ্নে ভারতের সহযোগিতা চায় বিএনপি। চলমান পরিস্থিতিতে ভারতও বিএনপিকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ভারত-বিএনপির সম্পর্ক মজবুত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘‘পার্টিুকুলারলি কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, বা কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না— এভাবে তো চলতে পারে না। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কটা অপরিহার্য-গুরুত্বপূর্ণ। এখন কথা হচ্ছে যে, ভারতের সঙ্গে আমি যে সুম্পর্ক রাখব, সেখানে আমাকে খেয়াল রাখতে হবে আমার কোনো অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা। ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট সংরক্ষণ করে অবশ্যই আমি প্রতিবেশির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখব। অযথা ঝগড়া-ঝাটি করাটা আমাদের জন্য মানানসই না।’’

‘‘রাজনীতিতে একটা দৃশ্যমান ব্যাপারে থাকে। আবার সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য অদৃশ্য একটা কূটনৈতিক তৎপরতা থাকে। সুতরাং কোনোটাকেই নেতিবাচক হিসেবে দেখার দরকার নেই। আবার কোনোটাকেই খুব বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখার দরকার নেই’’— বলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

পথ বিএনপি ভারত সম্পর্ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর