কর্মক্ষেত্রে এখনো নিশ্চিত হয়নি নারীর অধিকার
৪ মার্চ ২০২৫ ২২:২৬ | আপডেট: ৪ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৬
ঢাকা: ‘নারীদের নারী হিসেবে না ভেবে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গির আগে পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে নারীরা পিছিয়েই থাকবে।’- কথাগুলো বলছিলেন, জাহানারা খাতুন নামে একজন কর্মজীবী নারী।
বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ তার চিন্তা ভাবনা ও মেধা-মননে নিজেকে আধুনিক ভাবছে। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে কতটুকু ? এখনও নারীকে ধরে নেয়া হয় দুর্বল।
সুমিতা সেতু, পেশায় এনজিও কর্মী। সারাবাংলাকে সুমিতা বলেন, ‘আমি যখন কাজে ঢুকি, তখন অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ঢাকার বাহিরেও যেতে হতো। সেটা আমার আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার সমাজ থেকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি কাজ করে গেছি এবং এখনও করছি।’
সুমিতার মতে, ‘বাধা থাকবেই, কিন্তু নারীদেরকে থেমে পড়লে হবে না। নিজের কর্মস্থলটা যখন শক্ত হবে, আমরা যখন স্বাবলম্বী হবো, তখন একটা সময় সমাজ পেছন থেকে কথা বলাও থামিয়ে দিবে। তাই আইন ও নীতিমালার প্রয়োজন আছে ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি, নারীদের নিজেদেরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে।’
শ্রমশক্তির সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২৪ সালের জুন শেষে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার। এর আগের বছর (২০২৩ সালের জুন) একই সময়ে নারীদের এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ২০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমেছে ৭ লাখ ৮০ হাজার।
কর্মজীবী নারী সংগঠনের ডেপুটি ডিরেক্টর রাবিতা ইসলাম বলেন, ‘সেই ১৯০৯ সাল থেকে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। কিন্তু, কেনো আমরা এখনও এ দিবসে নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরি? কারণ আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারি নি। আমাদের এখনও প্রয়োজনগুলো, দাবিগুলো পূরণ করা হয় নি।’

দেশের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা – প্রতীকী ছবি
কর্মজীবী নারী সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, এখনও অনেক বিষয়ে সমতা আসে নি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
মাতৃত্বকালীন ছুটি: শ্রম আইনের ধারা-৪৬ অনুযায়ী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান ৬ মাস থাকলেও, এখনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা পোশাক শ্রমিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই আইন কার্যকর হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠানে, বিনা বেতনে ছুটিতে যেতে হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, ছুটি শেষে অফিস ফিরে গিয়ে তাদের চাকরিটাই ফেরত পায় না। সে ক্ষেত্রে আমাদের এতোদিনের দাবি বা আমাদের যে অধিকার মাতৃত্ব- সেটাকেই কিন্তু ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। সুতরাং এই মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটির এই বিধানটি প্রতিটি কর্ম প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন: এই দাবিটি নারীদের অনেক আগে থেকেই। একজন নারী যখন তার অফিসের কাজে ব্যস্ত। তখন তার ছোট্টো শিশুটি কোথায়? ঘরে একজন গৃহকর্মীর কাছে রেখে আসা কতটা নিরাপদ ? কিন্তু যদি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এই শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকে, তাহলে একজন কর্মজীবী মা, তার শিশুটিকে সেখানে রেখে নিশ্চিন্তে তার কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে শুধু মাত্র মায়েদের জন্যই নয়। পুরুষরাও কিন্তু তার সন্তানদেরকে সেখানে রাখতে পারছে। সুতরাং বলা যায়, আধুনিক এই যুগে, আধুনিক অনেক কারুকার্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও অফিস তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেখানে প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী ব্যক্তিদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গঠনের যে দাবি, সেটা এখনও পূরণ হয়নি।
কাজের কর্মঘন্টায় হেরফের: কাজের কর্মঘণ্টা ৮ ঘন্টা করার দাবিতে আন্দোলন করেছিলো কর্মজীবী শ্রমিকরা। কিন্তু এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখা যায়, ৮ ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেক্ষেত্রে একজন নারী, সে বাসায় যাবে। তার সংসারের কাজ করবে। সন্তানের দেখাশুনা করবে। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে নারী ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধরা হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে, তাকে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না- সে দাবি এখনো পূরণ হয়নি। বিশেষ করে, পোশাক কারখানাগুলো এ নিয়ম কানুন মেনে চলছে না।
পদ ও বেতনে বৈষম্য: বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই বড় পদে নারীরা নেই। বেতনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, একই বৈষম্য কাজ করে। নারীর চেয়ে পুরুষ সহকর্মীর সম্মানী বেশি। এই জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
কর্মজীবী নারী সংগঠনের ডেপুটি ডিরেক্টর রাবিতা ইসলাম আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের আইন থাকলেও আইনের ব্যবহার হচ্ছে না। জবাবদিহিতা নেই বলেই এই পরিবর্তনগুলো হচ্ছে না। সরকারিভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই জবাবদিহিতার জায়গায় আনতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাহলে নারীরা সম্মানজনকভাবে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে। সেটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও কার্যকরী হবে।’
মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব) মো. মনির হোসেন জানান, “নারী উন্নয়নে সরকারের যেসব আইন-কানুন রয়েছে তা আপডেট করার কার্যক্রম চলছে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। সরকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে হয়ে দেশগঠনে কাজ করে যাবো।”
সারাবাংলা/এফএন/আরএস