বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৪২০০ কোটি টাকা প্রতারক চক্রের পেটে
২২ জুন ২০১৮ ১৭:৩২
।। সারাবাংলা ডেস্ক ।।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কাজের সন্ধানে যাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে গত দুই বছরেই দুইশ কোটি মালয়েশিয়ান রিংগিত (প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার দুইশ কোটি টাকা) হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। মালয়েশিয়ার দ্য স্টার অনলাইনের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই প্রতারক চক্রের শীর্ষে রয়েছেন একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী যার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথেও রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, একেকজন শ্রমিককে এজেন্টের কাছে ২০ হাজার মালয়েশিয়ান রিংগিত করে দিতে হয়েছে। ওয়ার্ক পারমিট ও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার বিমানভাড়া বাবদ এই টাকার অর্ধেকই দিতে হয়েছে ওই পাচার চক্রকে। জানা গেছে, ২০১৬ সালের শেষের দিকে এই পাচার চক্রের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে পাঠানো হয়েছে মালয়েশিয়ায়। আরো প্রায় এক লাখ শ্রমিক এখন দেশটিতে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
মালয়েশিয়ান স্টারের অনুসন্ধানে বলা হয়, কোটি কোটি টাকার এই মানব পাচারকারী চক্রের হোতা মালয়েশিয়ার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, যার ‘দাতুক সেরি’ টাইটেলও রয়েছে। বাংলাদেশ ও মালয়েশেয়ার রাজনৈতিক মহলে প্রভাবশালী ওই ব্যবসায়ী দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শ্রমিক আমদানি-রফতানি বিষয়ক চুক্তি সইয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৬ সালে সই হওয়া ওই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের মাত্র ১০টি এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে করে করে বাংলাদেশের প্রায় দেড় হাজার এজেন্ট এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, অনুমোদন পাওয়া ওই ১০টি এজেন্সিও চুক্তি সইয়ের আগে রাতারাতি গড়ে ওঠে। সম্ভাব্য মালয়েশিয়ান নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলো ও আগ্রহী শ্রমিকদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে মূলত ‘দালালি’ করে টাকা কামানোর জন্যই গড়ে তোলা হয় কোম্পানিগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পাচার চক্র একেকজন শ্রমিকের কাছ থেকে ২০ হাজার রিংগিত করে নিলেও এর জন্য প্রকৃত খরচ মাত্র ২ হাজার রিংগিত। এর ফলে ওই চুক্তি সইয়ের পর মাত্র ২ বছরেই হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন চক্রের হোতা ওই ব্যবসায়ী।
একটি সূত্র বলছে, নিজে ধনী হওয়ার পাশাপাশি ওই ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এখন বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। আর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে রাখতে শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকার একটি অংশ তাদের দেওয়া হয়। ওই সূত্রটি জানায়, চল্লিশোর্ধ্ব ওই ব্যবসায়ী ১৫ বছর আগে মালয়েশিয়ান এক নারীকে বিয়ে করেছেন।
জানা গেছে, নিজের গড়ে তোলা প্রতারণা ব্যবস্থা ও অনুমোদন পাওয়া ১০ কোম্পানির কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে সিস্টেম পারখিদমাতান পেকারজা আসিং (এসপিপিএ) শিরোনামে নতুন একটি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমও চালু করা হয়েছে। একমাত্র এই রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের মাধ্যমেই বাংলাদেশ থেকে এখন শ্রমিক পাঠানো হয় মালয়েশিয়ায়। আর এই সিস্টেম পরিচালনা করে থাকে বেসটিনেট এসডিএন বিএইচডি নামের একটি প্রাইভেট কোম্পানি।
সূত্র বলছে, এসপিপিএ সিস্টেমের অধীনে একেকজন শ্রমিকের জন্য ৩০৫ মালয়েশিয়ান রিংগিত দিতে হয় নিয়োগদাতাদের। এই টাকা বেসটিনেট পায় সার্ভিস চার্জ হিসেবে। মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিকদের ভিসা আবেদন গ্রহণের জন্য অভিবাসী দফতর যে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ব্যবহার করে থাকে, সেটাও তৈরি করেছিল বেসটিনেট।
ক্ল্যাং ভ্যালেতে বেশ কয়েকটি নিয়োগদাতা কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে আসছেন চিরারা কানান। তিনি বলেন, এসপিপিএ ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর খরচ ছিল অনেক কম। ওই সময় একেকজন শ্রমিকের জন্য খরচ ছিল ৭ থেকে ৮ হাজার রিংগিত। কিন্তু এখন এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা শ্রমিকদের খরচ হয় দালালদের পেছনেই।
চিরারা বলেন, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় আসতে আগ্রহী শ্রমিকদের তাদের গ্রাম থেকেই ‘সাব-এজেন্ট’দের কাছে ২০ হাজার রিংগিত সমপরিমাণ টাকা দিতে হয়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ করা এজেন্টের কাছে ওই শ্রমিকের আবেদন পৌঁছানোর আগে আরো কমপক্ষে ২ ধাপে দালালের কাছে যেতে হয়। এর আগে লাইসেন্সধারী যেসব এজেন্সি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাত, তারা এখন ২০১৬ সালের চুক্তির অধীনে অনুমোদিত ১০ কোম্পানির ‘সাব-এজেন্টে’ পরিণত হয়েছে।
চিরারা আরো বলেন, পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে যখন মালয়েশিয়ার নিয়োগদাতারা বুঝতে পেরেছে যে শ্রমিকদের কাছ থেকে এখন এজেন্টরা বাড়তি টাকা নিচ্ছে। এই সুযোগ বুঝে তারা এখন শ্রমিক প্রতি কমিশন আদায় করতে শুরু করেছে এজেন্টদের কাছ থেকে। কোনো কোনো নিয়োগদাতা ১৫০০ রিংগিত পর্যন্তও নিচ্ছে। এসব কারণে মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের খাতটি ক্রমেই ‘নিষ্প্রভ’ হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন চিরারা।
সারাবাংলা/টিআর