Thursday 06 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘শ্রম আইনে নারী গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভূক্তকরণ- এখন সময়ের দাবি’

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৫ মার্চ ২০২৫ ২২:৪১ | আপডেট: ৬ মার্চ ২০২৫ ০০:১৫

ঢাকা: ভোর ৭টা। ছোট্টো শিশু আবরার-কে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে রেখে চলে গেলো লিজা আক্তার (২২)। আবার দুই ঘন্টা পর তাকে দেখা গেলো। বাজারের ব্যাগ হাতে আবরারকে নিতে এসেছে লিজা। জানা গেলো,আবরারদের বাসার গৃহকর্মী হিসেবে চার বছর ধরে সে কাজ করে আসছে।

সারাদিন কী কী কাজ করে- জানতে চাইলে লিজা সারাবাংলাকে জানায়- ‘‘ভোর ৫ টায় উঠে রুটি ভাজি, নাইলে সুজি বানাই। তারপর আবরারের টিফিন বাটিতে নাস্তা দেই। নিজে নাস্তা খেয়ে আবাররকে স্কুলে দিয়ে বাজার করি। আবার স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে আবরারকে গোছল করাই, খাওয়াই। এরই ফাঁকে রান্না করি, বাসন মাজি, কাপড় ধুই, ঘর গোছাই। এগুলো করতে করতেই বিকেল হয়ে যায়। সন্ধ্যায় আপা দুলাভাই বাসায় এলে, আবার তাদের জন্য নাস্তা বানাই। রাতেও টুকটাক রান্না করি। ’’

বিজ্ঞাপন

সারাদিনে মোট কত ঘন্টা কাজ করো- এমন প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লিজা। বলে- ‘‘সারাদিনই তো কাজ করি। ঘন্টা তো হিসাব করি না।’’

গৃহকর্মে নিয়োজিত নারী শ্রমিক – প্রতীকী ছবি

শ্রমিক হিসেবে আইনি সুরক্ষার আওতায় নেই লিজা আক্তারের মতো গৃহকর্মীরা। এ সংক্রান্ত আইন বা নীতিমালা সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই তাদের। ছুটি, বিনোদন, পারিশ্রমিক, কর্মঘণ্টা, চিকিৎসা ও পড়াশোনা সবকিছুর বাইরেই তারা। গৃহশ্রমিকদের সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এই অবস্থায় গৃহশ্রমিকের অধিকার আদায়ে শ্রম আইন ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের অন্তর্ভূক্ত করাসহ গৃহশ্রমের জন্য পৃথক আইন করা এখন সময়ের দাবি- বলে মন্তব্য করেছেন কর্মজীবী নারী সংগঠনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহানা তিথি।

ফারহানা তিথি সারাবাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী গৃহ শ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি এখনো। তাদেরকে সেভাবে স্বীকৃতিও দেয়া হয় না। শ্রম আইনের ধারা অনুযায়ী যে অধিকারগুলো আছে, সেই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত এই গৃহ শ্রমিকরা। আর মজুরি ও কর্মঘন্ট এ ধরনের বৈষম্য তো আছেই। শ্রম আইনের ২০০৬ এর ধারা ৪ এর ‘ণ’ তে উল্লেখ আছে, ‘গৃহকর্মীরা
এই আইনে অন্তর্ভূক্ত হবেন-না।’ ‘না’ শব্দটি লেখা রয়েছে। যা খুবই দু:খজনক।’’

বিজ্ঞাপন

গৃহকর্মীদেরকে শ্রমআইনের ২০০৬ অনুযায়ী নীতিমালায় অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানিয়ে গৃহে কর্মরত গৃহকর্মীর জন্য শোভন কাজ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিতকরণে বেশকিছু পরিকল্পনা তুলে ধরেন ফারহানা তিথি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

নিয়োগপত্র বা চুক্তি: একটা চুক্তিপত্র হাতে পাওয়া একজন গৃহকর্মীর অধিকার।এই চুক্তিপত্র সম্পর্কে আমাদের গৃহশ্রমিক কর্মীদের অধিকাংশই জানে না। কিন্তু চুক্তিপত্রে তার কর্মঘন্টা, কাজের বিবরণ ও ছুটির বিষয় এবং সব ভাতা সম্পর্কে লিখিত থাকবে। এ চুক্তিপত্রের কপি বা নিয়োগপত্র থানায় জমা থাকলে গৃহকর্মী নির্যাতনমুক্ত থাকবে। আর যদি তারপরও নির্যাতনের স্বীকার হয়, সেক্ষেত্রে আইনি বিচারিক কাজে নিয়োগপত্রটি কাজে লাগবে। আমাদের দেশে অফিসগুলোতে নিয়োগ বা চুক্তিপত্র দেয়া হলেও গৃহশ্রমিক কর্মীদের দেওয়া হয় না। এই চুক্তিপত্র আইনের আওতায় এনে চালু করতে হবে। তাহলে নারী গৃহকর্মীরা সুরক্ষিত থাকবে।

কর্মঘন্টা: স্থায়ীভাবে যেসব গৃহকর্মীরা গৃহে কাজ করেন। তাদের কর্মঘন্টাও ৮ ঘন্টা রাখতে হবে। সে স্থায়ীভাবে কাজ করে বলেই, তাকে সারাদিন কাজের উপরে থাকতে হবে- তা তো নয়। সারাদিনে কাজ করলেও সেটা যেন ৮ ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

মজুরি নির্ধারণ: উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারিত হবে। পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে গৃহকর্মীর পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী হয়, নিয়োগকারী তা নিশ্চিত করবেন। গৃহকর্মীর ভরণপোষণ, পোশাক-পরিচ্ছদ দেওয়া হলে তা মজুরির অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে। উৎসব ভাতা থাকতে হবে। মাতৃত্বকালীন ভাতাও থাকতে হবে। অতিরিক্ত কাজের জন্যও বোনাস থাকা উচিত।

গৃহকর্মীর বয়স: গৃহকর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর বিধান অনুসরণ করতে হবে। ১৪ বছর পূর্ণ করেছে, তবে ১৮ বছরের কম এরূপ বয়সে গৃহকর্মে নিয়োজিত কিশোর বা কিশোরীদেরকে হালকা কাজ করাতে হবে। এবং ১২ বছর বয়োপ্রাপ্ত শিশুনিয়োগ করতে হলে আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে নিয়োগপ্রদান করতে হবে।

কিশোরী কর্মীদের ক্ষেত্রে লেখাপড়ার সুযোগ: গৃহকর্মী কিশোরী হলে তাকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি, খেলাধুলা এবং বিনোদনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। তাদের বেতন ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতে হবে।

মাতৃত্বকালীন ছুটি: ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি, সেটা একজন গৃহকর্মীর জন্যও প্রযোজ্য। আর এ সময় তাকে একটা বেতনও দিতে হবে। স্থায়ীভাবে যে গৃহকর্মী ৪ থেকে ৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করছে, তার মাতৃত্বকালীন সময়ে তাকে নিজের সুবিধার্থে কাজ থেকে বাদ দিলাম কিংবা সে ছুটি পেলো, কিন্তু বেতন পেলো না- এটা অন্যায়।

এ বিষয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক সারাবাংলা’কে বলেন, ‘‘আমরা নারীবিষয়ক যে সংস্কার প্রস্তাবনা করছি, সেখানে নারীশ্রমিকদের অধিকারগুলোও উল্লেখ আছে। এখন পর্যন্ত সব ঠিক থাকলে আমরা ৩১ মার্চ এই সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দিবো। আশা করছি, গৃহকর্মীরা এবার তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে।’’

দারিদ্রতা বা জীবনের তাগিদে কাজ করে যাচ্ছে নারী গৃহ শ্রমিকরা। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে শ্রম আইনে এই নারী শ্রমিকদের অন্তর্ভূক্ত করা- এখন সময়ের দাবি।

সারাবাংলা/এফএন/আরএস

শ্রম আইনে নারী গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভূক্তকরণ