সংকট কাটেনি সয়াবিন তেলের
৬ মার্চ ২০২৫ ১৪:৫৮ | আপডেট: ৬ মার্চ ২০২৫ ১৫:১১
ঢাকা: দেশের বিভিন্ন এলাকায় সয়াবিন তেলের সংকট এখনও কাটেনি। বাজারগুলোতে স্বল্প পরিসরে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও শহরের অলিগলির দোকানগুলোতে সয়াবিন তেলের হাহাকার চলছে। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলোতেও একই অবস্থা। সরকার নির্ধারিত ১৭৫ টাকার সয়াবিন তেল কোথাও কোথাও ২০০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল কিনতে প্রায় ৫০ টাকার মতো বাড়তি গুণতে হচ্ছে।
খুচরা বিক্রিতাদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। বড় বাজারের খুচরা বিক্রেতারও বলছেন, হাতেগোনা দুই একটি কোম্পানির সয়াবিন তেল পাচ্ছেন তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গায়ের রেটে সয়াবিন তেলের বোতল কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। আবার কোনো কোনো কোম্পানি সয়াবিন তেলের সঙ্গে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে অপ্রচলিত পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছে। আর সরকার তেল সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজারে তাদের কথার কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না।
বুধবার (৫ মার্চ) রাজধানীর একাধিক বাজার, বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকান ও ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ইব্রাহিমপুরের পাকারমাথা এলাকার হৃদয় জেনারেল স্টোরের বিক্রিয়কর্মী রবিউল হাসান গাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত দুই থেকে তিন মাস ধরে আমরা সয়াবিন তেল পাই না। কোম্পানির লোক আসে না। বাধ্য হয়ে আমরা এখন সান ফ্লাওয়ার ও সূর্যমুখী তেল বিক্রি করছি। কখনো কখনো রেশনের তেল বেশি দামে কিনে এনে বিক্রি করছি।’
একই এলাকার আরিফ জেনারেল স্টোরের মালিক আরিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকমাস ধরে দোকানে সয়াবিন তেল নেই। ক্যানোলা তেল বিক্রি করি। তবে রুপচাদার এক লিটারের পলিব্যাগ আছে। দাম ১৭৫ টাকা।’
শেওড়াপাড়ার নাহার বেকারির এক মোদি দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এক লিটার তেল এখন ২০০ টাকা, দুই লিটার ৪০০ টাকা ও তিন লিটার ৫৭৫ টাকায় বিক্রি করছি। তেলে সেভাবে লাভ থাকে না। আর ৫০ হাজার টাকার তেল কিনলে মাত্র ২০০ টাকা লাভ থাকে। তেল পাচ্ছিও না, আবার লাভও দেয় না। কিনে পোষায় না, না কিনেও পারি না। একদিকে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে হবে। আবার গায়ের রেট থেকে বেশি দামেও বিক্রি করা যায় না। তেল নিয়ে আমরা বিক্রেতারা আছি উভয় সংকটে।’
একই এলাকার হুমাইরা স্টোরের রাসেল বলেন, ‘গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে তেল নেই। হাফ লিটারের বোতল আছে। ১০০ টাকা করে বিক্রি করছি। মাঝেমধ্যে এক কার্টন করে তেল পাই। এক দুই দিনেই শেষ হয়ে যায়।’
তেজগাঁও এলাকার শাহীনবাগের মনিহারি দোকানদার পনু সারাবাংলাকে বলেন, ‘তীরের সয়াবিন তেল পাই না পায় দুই মাস ধরে। মাঝেমধ্যে অনেক অনুরোধ করে ফ্রেশের তেল রাখি। আর বসুন্ধরার তেল মার্কেটে নেই। কয়েকটি কোম্পানি তেল কিনতে চাইলে তারা তেলের সঙ্গে এখন অন্য পণ্য ধরিয়ে দেয়। ফ্রেশের তেল কিনলে সঙ্গে ন্যাচারাল তেল নিতে হয়। কোনো কোনো কোম্পানি রাইসব্রান বা অপ্রচলিত পণ্য ধরিয়ে দেয়। এক লিটার ১৭৩ টাকা পড়লেও বিক্রি করতে হয় ১৮০ টাকায়।’
মহাখালীর বাউবাজারের মিতু এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তেল কিনতে হলে এখন সঙ্গে করে আটা ময়দা, চিনি, লবণ কিনতে হয়। যখন যে পণ্য কম চলে তেলের সঙ্গে কোম্পানির ওই পণ্যটি ধরিয়ে দেয়। নইলে তেল দেয় না। বাজারে বসুন্ধরার তেল নেই অনেকদিন। রোজার দুই তিন মাস আগে থেকেই বসুন্ধরার তেল নেই।’
তিনি বলেন, ‘এক লিটার তেলের গায়ের রেট ১৭৫ টাকা, আমাদের কিনতেও হয় ১৭৫ টাকা দিয়ে। পরে বাধ্য হয়েই বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। সেনা ৫ লিটারের বোতল ৮৫০ টাকা করে কিনেছি। ১০ কার্টন কিনেছি ৩৪ হাজার টাকা। এক টাকাও কম রাখেনি। এখন বিক্রি করতে হবে গায়ের রেট থেকে বেশি। ৮৬০ থেকে ৮৭০ টাকা বিক্রি করতে হবে।’
একই বাজারে অন্য একটি দোকানে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা ও ৫ লিটারের বোতল ৮৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তবে কারওয়ানবাজারে সয়াবিন তেলের সংকট নেই। বাজারটিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সয়াবিন তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই বাজারের কিচেন মার্কেটের মায়ের দোয়া স্টোরের কর্মচারী বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন সব কোম্পানি তেল বিক্রি শুরু করেনি। এই বাজারে পুষ্টি ও ফ্রেশ তেলের সরবরাহ রয়েছে। বাকি কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেল পাইনা। আগে লিটারে ৫ টাকা লাভ থাকলেও এখন ২ টাকা লাভ দেয়। অর্থাৎ ১৭৫ টাকার বোতল আমাদের কিনতে হয় ১৭৩ টাকায়। ফলে বেত বিক্রিতে সেভাবে লাভ থাকেনা।’
এদিকে ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়েও সয়াবিন তেলের সংকট রয়েছে। ওই এলাকার একজন মুদি দোকানদার সুমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে তেলের সংকট আগের মতোই রয়েছে। সব কোম্পানি তেল দেয় না। একমাত্র ফ্রেশ কোম্পানি তাদের পিউর ব্রান্ডের এক লিটারের তেল দেয় মাঝেমধ্য।’
তিনি বলেন, ‘গায়ের রেটে যে দাম লেখা রয়েছে তার চেয়ে বেশি দামে আমাদের তেল কিনতে হচ্ছে। কোম্পানি মেমোতে বিক্রিমূল্য ১৭৪ টাকা লিখলেও তারা ১৭৮ টাকা করে আদায় করে। সঙ্গে আটা, ময়দা ও অন্যান্য পণ্য কিনতে হয়। আমরা ১৯০ থেকে ২০০ টাকা লিটারে তেল বিক্রি করি। বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়াই যায় না।’
একই এলাকার আরেকজন মুদি দোকানদার বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যায়না। এখন খোলা সয়াবিন বিক্রি করছি। খোলা সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ২০০ টাকা লিটারে বিক্রি করছি।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খুচরা বিক্রি করি না। আমরা পাইকারিতে বিক্রি করি। পাইকারিতে ৮০০ টাকা মণ কমেছে। এবং পাম তেল সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ১৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে কোটি কোটি খুচরা ব্যবসায়ী আছে, তাদের দেখভাল তো আমি করতে পারব না! সেটা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখবে। তবে বোতলজাত তেল আমাদের আওতায় পড়ে না। যারা উৎপাদন করে, রিফাইন করে, তাদের পরিবেশক রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিটি, টিকে গ্রুপ, মেঘনা- এসব গ্রুপ দেশের চাহিদা মেটাতো তো পারেই, টিসিবিকেও এরা বোতলজাত তেল দিচ্ছে। টিসিবি ভর্তুকি রেটে তেল বিক্রি করে, এ জন্য বোতলজাত তেল হয়তো একটু শর্ট। তবে খোলা সয়াবিন তেলের সংকট নেই।’
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংকট কাটানোর চেষ্টা হলে তো সংকট কাটবে। সরকার তেলের সংকট কাটাতে কি ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা এখনও দৃশ্যমাণ নয়। সঠিকভাবে মনিটরিং হচ্ছে না। আবার টিসিবির জন্য তেল কিনছে লোকাল মার্কেট থেকে। অথচ এই তেল আনার কথা ছিল দেশের বাইরে থেকে। টিসিবির জন্য খোলাবাজার থেকে তেল কেনায় বোতলজাত বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট হচ্ছে। কোম্পানির লোক বলছে তারা তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছে। কোম্পানি ও ডিলারসহ সব পক্ষকে নিয়ে সরকারের বসা উচিত ছিল, সেটি হয়নি। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। সেটি এক মাস হয়ে গেলেও তেলের সংকট কাটেনি।’
এদিকে তেল বিপণনকারী শীর্ষ কোম্পানিগুলো মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। সিটি গ্রুপের সয়াবিন তেলের ব্র্যান্ড তীর। বাজার পরিস্থিতি জানতে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহাকে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
টিকে গ্রুপের সয়াবিন তেলের ব্র্যান্ড পুষ্টি। টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিমকে কল করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তেল সংকটের অভিযোগের তীরে থাকা কোম্পানিগুলোর বক্তব্য জানা যায়নি।
এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানকে একাধিবার কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফলে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতদূর, তাও জানা সম্ভব হয়নি।
সারাবাংলা/ইএইচটি/ইআ