নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা
দায়ী মানসিকতা, পুরুষতান্ত্রিক আচরণ ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি
৬ মার্চ ২০২৫ ২২:৩১ | আপডেট: ৬ মার্চ ২০২৫ ২২:৪৩
ঢাকা: বেগম রোকেয়া বা সুফিয়া কামালের মতো নারীদের এখন আর অবরুদ্ধ সামাজিক আর পারিবারিক বন্ধনের বিরুদ্ধে লড়ে নিজেদের গড়ে তোলার সংগ্রাম করতে হয় না। ইতিহাস বিনির্মাণে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। এর প্রমাণ মেলে সভ্যতার গোড়াপত্তনে কৃষিকাজে নারীর ভূমিকায়।
তবে, পুরুষের তুলনায় শারীরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকা নারীর উপর নির্যাতন সেই আবহমানকাল থেকে। সভ্যতা এগোলেও কমেনি নির্যাতন। বরং বদলেছে ধরণ। দিনকে দিন নির্মমের চেয়েও নির্মমতর হচ্ছে নির্যাতনের ধরণ। তা এতোটাই নিন্দনীয় যে, নিজ পরিবারেই নিরাপদ থাকছে না নারী। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি কর্মক্ষেত্রে, এমনকি নিজ শয়নকক্ষেও। শুধু নারীই নয়, কিশোরীরাও। এখন শিশুদেরও নিরাপদ রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত নারীদের উপর সহিংসতা শীর্ষক জরিপ ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকে দেশে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। দশ বছর আগে ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতা ছিল ২৭.২ শতাংশ।

ছবি : প্রতীকী (সংগৃহীত)
সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া এবং এর প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মুসলিম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতির কারনে এ ধরণের নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে। গত এক বছরে আমরা দেখেছি যে, অনেক কয়েদি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাহলে অপরাধীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে মজবুত করা উচিত।’
এদিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী তাদের জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার। বাংলাদেশে জীবনসঙ্গীর দ্বারা সহিংসতা এখনো ব্যাপকভাবে বিদ্যমান, যা লাখ লাখ নারীর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। শুধু স্বামীই নয়, প্রেমিকার দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেকেই।
বিবিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে ৯৩.৬ শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এছাড়া সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না।
এ বিষয়ে কর্মজীবী নারী সংগঠনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহানা তিথি বলেন, ‘আমাদের দেশে আগেও ‘মব জাস্টিস’ এর ঘটনা ঘটেছিলো। একজন মাকে ছেলেধরা বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন এ ঘটনাগুলো এখন আরোও বেশি হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ‘মব জাস্টিস’ ঘটনাগুলো ঘটছে। তাই নারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রয়োজন।’
বিবিএস’র তথ্য মতে, নারীদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৪ শতাংশ) জীবদ্দশায় তাদের স্বামীর দ্বারা শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতা বা উভয় সহিংসতার সম্মুখীন হলেও ১৬ শতাংশ নারী গত ১২ মাসে এই ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। এ ছাড়াও, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ এবং মানসিক সহিংসতা সর্বাধিক সংঘটিত সহিংসতার ধরণ হিসাবে পাওয়া গেছে, ফলে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সিউতি সবুর বলেন, ‘আসলে পুরুষদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক আচরণ বিদ্যমান। অর্থাৎ আমি পুরুষ, আর তুমি নারী মানে দুর্বলের প্রতীক। আর তাই পুরুষতান্ত্রিক এই আচরণের কারণে যৌন হয়রানিটা হচ্ছে। সেটা শুধুমাত্র যে ধর্ষণ, তা কিন্তু নয়। নিজ পরিবার থেকে শুরু করে রাজপথে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা। কেউ বাজে মন্তব্য করছে। কেউ চলতে পথে ধাক্কা দিচ্ছে। আর বড় ধরণের ঘটনার মধ্যে এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, খুন এগুলোতো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক আচরণের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। হজের সময় নারী পুরুষ সবাই থাকে, কিন্তু সেখানে সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটে না। কারণ সেখানে তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকে, তাদের মাথায় সহিংসতার কোনো চিন্তাই আসে না। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।’
সারাবাংলা/এফএন/আরএস