Saturday 05 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অ্যাসিড সন্ত্রাস কমলেও আক্রান্তদের জীবনমান উন্নয়নে নেই পদক্ষেপ

নাজনীন লাকী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৮ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০২৫ ১১:৫৪

ঢাকা: দেশে একটা সময় অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন মায়ের কোলে থাকা ১৮ দিন বয়সের শিশু থেকে শুরু করে ৬২ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত। এমনকি রেহাই পাইনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীও। তবে বর্তমানে কমেছে অ্যাসিড আক্রান্তের হার। ২০০২ সালে বছরে ৪৯৬ জন অ্যাসিড হামলার শিকার হলেও ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ১৮ জনে। আইন, অ্যাসিড বেচা-কেনায় বাধ্যতামূলক লাইসেন্স থাকার বিধান ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণেই অ্যাসিড সন্ত্রাস কমে আসার মূল কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশে অ্যাসিড আক্রান্তের পরিসংখ্যান

দেশে অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্যমতে, ১৯৯৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৪৮৮টি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় আহত হয়েছে ৩ হাজার ৮৯৭ জন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ২৩ জন নারী ও ৯৬১ জন পুরুষ। বাকি ৯১৩টিই শিশু।

বিজ্ঞাপন

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে সারাদেশে ১৬৫টি এসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় আক্রান্ত হন ১৬৮ জন। ২০০০ সালে ২৪০টি ঘটনায় আক্রান্ত ২৪০ জন, ২০০১ সালে ৩৫১টি ঘটনায় আক্রান্ত ৩৫২ জন, ২০০২সালে ৪৯৪টি ঘটনায় আক্রান্ত ৪৯৬ জন, ২০০৩ সালে সারাদেশে ৪১৭টি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় আক্রান্ত হন ৪২০ জন। ২০০৪-এ ৩২৬টি ঘটনায় আক্রান্ত হন ৩৩৩ জন।

২০০৫ সাল থেকে এই সন্ত্রাসের ঘটনা কমতে থাকে। ২২২টি ঘটনায় ওই বছর আক্রান্ত হন ২৭৭ জন। কমতে কমতে ২০২৪ সালে অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে দু’জন এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মাঝে একজন মারা গেছেন।

অ্যাসিড সন্ত্রাসের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

অ্যাসিড সন্ত্রাসের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

আইন, মামলার সংখ্যা ও নিষ্পত্তির হার

অ্যাসিড সন্ত্রাসের হার কমাতে ২০০২ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ‘এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২’-এর ৪ নম্বর ধারায় অ্যাসিডের আঘাতে কারও মৃত্যু ঘটলে হামলাকারীর মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া, আইনের ৫ ধারায় অ্যাসিড দ্বারা কাউকে মারাত্মকভাবে আহত করার শাস্তি হিসেবেও আসামির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড রাখা হয়। পাশাপাশি অ্যাসিড-হামলা চালিয়ে ভিকটিমের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করার শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও ন্যূনতম সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। সেইসঙ্গে অ্যাসিড কেনা-বেচার ক্ষেত্রেও কঠোর নিয়ম করা হয়।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় সারাদেশে মোট দুই হাজার ১৯টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৮৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলাগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন ৩২৫ জন। যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন ১১৭জন। আর ১৪ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের রায়। তবে এসব মৃত্যুদণ্ডের একটিও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

অ্যাসিড সন্ত্রাসের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

অ্যাসিড সন্ত্রাসের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অ্যাসিড আক্রান্ত মানুষগুলো

অ্যাসিড আক্রমণের পরে তার বিকৃত চেহারা কখনোই তার দৃঢ় সংকল্পকে থামায়নি, বরং তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবনে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া একজন সাহসী বীর তাহমিনা ইসলাম। নিজের জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি নানা কাজে যুক্ত হয়ে সমাজ বদলাতেও ভূমিকা পালন করছেন তিনি।

চোখে অশ্রু আর কণ্ঠে হাজারো কষ্টের দলা পাকিয়ে আসা প্রতিটা শব্দই যেন তাহমিনা ইসলামের জীবন পাল্টে দেওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল। অশ্রুভেজা কণ্ঠে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি ২০০০ সালে অ্যাসিড আক্রান্তের শিকার হই। এরপর থেকে আমার জীবনটি পাল্টে যায়। আমার মুখে মোট ১৮-১৯ তা সার্জারি হয়েছে। এতে এত কষ্ট যে এর পর আর সার্জারি করার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলি। এরপর এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ হলে যখন দেখি আমার মতো অনেকেই আছেন। তারাও জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছেন। তখন আমি অ্যাসিড আক্রান্তদের জন্য কিছু করার সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সেই হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমি অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছি। আমার মতো অন্যদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের পাশে থেকে কাজ করছি। আমি আমার বাকিটা জীবন তাদের জন্যই কাজ করে যেতে চাই।’

অ্যাসিড আক্রান্তদের পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

অ্যাসিড আক্রান্তদের পরিসংখ্যান। ছবি: সারাবাংলা

অ্যাসিড আক্রান্তের শিকার শামীমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অ্যাসিড আক্রান্তের পর আমি এক বছর নিজের চেহারা আয়নায় দেখিনি। এ সময় আমি ঘরের বাইরেও যায়নি। একসময় ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করতে। কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে আমি নিজেকে সামলে নিই। এর পর আমি বাইরে বের হয়ে আসি। এখন আমি আমার সাহস আর ইচ্ছের জোরে নিজেকে যেমন সহযোগিতা করছি, তেমনি আমার পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছি। এখন আমি আমার মতো যারা আছেন তাদের জন্যে কাজ করছি।’

অ্যাসিড আক্রান্তদের দাবি, বর্তমানে অ্যাসিড আক্রান্তের হার কমে গেছে, এটা ভালো দিক। কিন্তু যারা আক্রান্তের শিকার তাদের জন্য যে এখনো অনেক কিছু করার আসে সে বিষয়ে সবাইকে নজর দিতে হবে। দেশের প্রায় চার হাজারের মতো অ্যাসিড আক্রান্তদের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আমরাও যে সমাজের একটা অংশ সেটাকে মাথায় রেখে সরকারি নানা পরিকল্পনাতে যুক্ত করা উচিত।

এ বিষয়ে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সামিয়া আহমেদ সারাবাংলাকে আরও বলেন, ‘বর্তমানে ২৪টি জেলায় আমাদের এই সময়ে কাজ চলমান আছে। দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় অ্যাসিড আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সিলিং করে থাকি। আক্রান্তদের মেডিকেল চিকিৎসাটাও দেখছি। সেইসঙ্গে জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি। আমরা পড়াশোনা ও তাদের দক্ষতা উন্নয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়া এসিড নিক্ষেপের ঘটনা নির্মূল না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সামিয়া আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অ্যাসিড-সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে থাকে, তাহলে কখনোই এটা চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাসিড সন্ত্রাস শূন্যের কোঠায় আনতে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সরকারের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নাগরিক সমাজ, স্বেছাসেবী সংস্থা, সাধারণ মানুষের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।’

সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম

অ্যাসিড সন্ত্রাস নারী শিশু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর