তথ্যপ্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্বের জায়গায় নেই নারী
৮ মার্চ ২০২৫ ১৭:২২ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০২৫ ২০:৫৬
ঢাকা: একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তিখাতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চিন্তাতীত। প্রযুক্তিতে ভালো সম্ভাবনা আছে, এটাতে যে ক্যারিয়ার গঠন সম্ভব— একটা সময় অভিভাবকদের এ বিষয়টি বোঝানোই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এখন সময় অনেকটাই বদলে গেছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের নারীরা। নিজ নিজ সেক্টরে রেখে চলেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। আইসিটি খাতে আউটর্সোসিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়েবসাইট তৈরিসহ নানা কাজে এগিয়ে এসেছে নারীরা। এতকিছুর পরও নেতৃত্বের জায়গায় নারীদের অবদান তেমন নেই।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে শূন্য হাতে সফটওয়্যার খাতে কাজ শুরু করা ইউওয়াই সিস্টেম্স লিমিটেডের সিইও ফারহানা এ রহমান এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন সফল তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি কথা বলেন তার দীর্ঘ পথচলার চরাই উৎরাই নিয়ে। কথা বলেছেন, এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়েও। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান ইউ ওয়াই সিস্টেম, বিশ্বের ১২টি দেশে সফটওয়্যার আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। বর্তমানে ভিয়েতনাম যোগ হয়েছে। সেইসঙ্গে আমরা দক্ষতা বৃদ্ধিতে আইটি প্রশিক্ষণ নিয়েও কাজ করছি।’
নারীদের এই খাতে অংশগ্রহণ নিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখেছি, আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে একটা বক্সের মধ্যে বেঁধে রাখা হয়। মেয়েদের স্বপ্ন দেখার জায়গাটুকুই বন্ধ করে রাখা হয়।’
তিনি যোগ করেন, বিভিন্ন সময় সরকারি সুবিধা-অসুবিধা ও সহযোগিতার অপ্রতুলতা এবং সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। তাই এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ কম।
ফারহানা এ রহমান এ খাতে আসা নতুনদের জন্য বলেন, ‘বর্তমানে আমরা সবাই সবকিছুতেই শর্টকাট খুঁজি, খুব তাড়াতাড়ি সফলতা দেখতে চাই। এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে উদ্যোক্তা হতে হলে স্বপ্ন দেখে যেতে হবে, এগিয়ে যেতে পথে সব বাধাকে অতিক্রম করতে হবে। তবেই মিলবে সাফল্য।’
এদিকে, রেইনড্রপস টেক লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিশাত মাসফিকা বলেন, ‘নিত্য নতুন আবিস্কার, নতুন কিছু শেখার জায়গা থেকে এই খাতে আমার পথ চলা। প্রযুক্তি নিয়ে যেকোনো কাজ আমাকে যেমন আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি বিশ্বের সঙ্গে আপডেট থাকতে পারছি।’
নারীদের প্রযুক্তি খাতে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু চালেঞ্জের মধ্যে এখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা অন্যতম।
অনেক সময় প্রথাগত ধারণা ও সামাজিক রীতিনীতির কারণে নারীরা প্রযুক্তি খাতে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চান না বা পারেন না। ফলে নারীরা তখন পিছিয়ে পরেন।
এই খাতে নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো হল:
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা
- পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব
- কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য
- প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব
- সঠিক নেটওয়ার্কিং ও মেন্টরশিপের অভাব
- কর্মস্থলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সমর্থনের অভাব
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন:
- একটি সমর্থনমূলক ও সহযোগী পরিবেশ গঠন করা, যেখানে নারীরা শেখার সুযোগ পাবেন।
- প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ নারী বা পুরুষ মেন্টরদের সঙ্গে যুক্ত করা, যারা প্রযুক্তির খুঁটি-নাটি সব শেখার পথে তাদের গাইড করতে পারেন।
- সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর প্রশিক্ষণ।
- ভয় কাটানো
- আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, যা তাদের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে।
- সেসঙ্গে এই খাতে উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট অনেকের জন্য সহজলভ্য নয়, যা প্রযুক্তি শিক্ষা এবং অনলাইন সংস্থান ব্যবহারে বাঁধা সৃষ্টি করে। যার কারণে অনেকের পক্ষেই তখন অনলাইন কোর্স, ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে, যা নারীদের প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জনে বাঁধা দেয় বলে আমি মনে করি। অনেক পরিবারের জন্য ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্যের খরচ পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি ও নারীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রয়োজন:
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো। প্রযুক্তি নিয়েও যে ঘরে বসে ভালো ক্যারিয়ার গঠন করা যায়, ইনকাম করা যায়-এই বিষয়ে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এছাড়া আলোচনা করা, ভয় কাটানো, সাইবার বুলিংসহ অন্যান্য বিষয়ে সচেতন করে তোলা। প্রযুক্তি বিষয়ে বেশি বেশি ওয়ার্কশপ, সেমিনার, প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। এর ভবিষ্যতের ভালো দিকগুলো তুলে ধরা। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, দীর্ঘ ২৫ বছর থেকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন নাজনীন নাহার। টেক ওয়ার্ল্ড এর সম্পাদক ও প্রকাশক, বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের (বিআইজেএফ) সাবেক সভাপতি হিসেবেও নেতৃত্বের জায়গায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তার এই সাংবাদিকতার পথচলায় বলেন, ২০০২ থেকে এখন পর্যন্ত এই খাতে আমার বিচরণ। সেই সময় থেকেই এই খাতে নারীর সংখ্যা কম। যা প্রশংসনীয় নয়।
তিনি বলেন, ‘দেশে মাত্র ২৪ ভাগ নারীরা ইন্টারনেটনেট ব্যবহার করছে। ৩০ শতাংশ আইসিটির নানা বিষয়ে পড়াশোনা করলেও এই খাতে কাজে যুক্ত হচ্ছেন মাত্র ১২-১৩ শতাংশ নারী। তাই এই খাতে যে হারে নারীর সংখ্যা বাড়ার কথা সেই হারে বাড়ছে না। এর কারণ হিসেবে বলছেন ৪টি কারণ। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র ও রাষ্ট্রীয় এই ৪টি জায়গা থেকে নারীরা পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে না বলেই এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ বাড়ছে না। আর যারা এগিয়ে আসছেন তাদের যোগ্যতা প্রমাণের জায়গাতে বারবার নারীদেরকে প্রমাণ করতে হচ্ছে। এটাও নারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন নাজনীন নাহার।
আমেরিকায় না গিয়ে, দেশেই ২০১০ সালে গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘টুগেদার ইনিশিয়েটিভ’। আর পরে ২০১৭ সালে লুজলি কাপলড টেকনোলজিস-এর চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রথিষ্ঠির করেছেন তরুণ সফল উদ্যোক্তা সৈয়দা নওশাদ জাহান প্রমি।
এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ কম মানতে নারাজ এ তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘বিগত বছরগুলো থেকে অনেকংশেই বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। তবে কমেছে নারীর নেতৃত্বের জায়গাটা। বিশেষ করে নারীরা পারিবারিক নানা কাজে বেশি জড়িত থাকে। স্বামী, সংসার, বাচ্চাকে সময় দিতে গিয়ে নারীরা লিডারশীপে যেতে চাইছে না। এর ফলে আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নেতৃত্বের জায়গাতে ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। নারীরা এই জায়গাতে আর বেশি এগুতে পারছে না।’
পাশাপাশি আইসিটি খাতে একজন নতুন নারী উদ্যোক্তাকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে নিজেকে দক্ষ করে তৈরী করতে হবে —এমনটাই জানাচ্ছিলেন সফল এ নারী উদ্যোক্তা। বিভিন্ন ট্রেনিং করে নিজেকে গড়ে তোলা। পাশাপাশি সামাজিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতাকে পার করার মানসিকতা রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া। সেসঙ্গে নিজের মতামত সবার উপর রাখার মনোভাবটাও দরকার।
এদিকে, পরিবারের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে নিজ ইচ্ছায় এসেছেন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়। গড়ে তুলেছেন নিজ প্রতিষ্ঠান জিজিডট লিমিটেড। অ্যাডভান্স ডিজিটাল মার্কেটিং সেবা সরবরাহে বিগত ৯ বছরের বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন ডিজিডট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাফীসা রেজা বর্ষা।
নারীরা সব ক্ষেত্রেই একটু বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তাই নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলা সেসঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতাও বাড়াতে হবে। নিজেকে নিজে এগিয়েই নিতে হবে এর বিকল্প নেই। বলেন ব্যক্তিগত জীবন, সংসার জীবন, কর্মজীবন সব একসাথে সমন্বয় করেই নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে এগিয়ে নিতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে প্রযুক্তির সঙ্গে আপডেট রাখতে হবে।
সেইসঙ্গে সরকারি বা বেসরকারিভাবে নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়ে যে ঝরে যাওয়ার আশংকা থাকে সেই বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে কার্যক্রম হাতে নিলে এই খাতে নারীর অংশ গ্রহণ বাড়বে বলে মনে করেন এই তরুণ আইসিটি উদ্যোক্তা।
আইসিটি খাতে এই উদ্যোক্তারা নিজ নিজ জগতে একেকজন আলোকবর্তিকা। যারা নিজেদের আলোয় আলোকিত করছেন আইসিটি খাতের নারীদের পথচলা।
সারাবাংলা/এনএল/এমপি