ঢাকা: বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ৮ মার্চ- আন্তর্জাতিক নারী দিবস। মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি সম্মান রেখে পালিত হচ্ছে দিবসটি। অন্তত এই একটি দিন গোটা বিশ্ব আলাদা করে ভাবে, নারীরাই এ জগতে শক্তি ও প্রেরণার উৎস।
নারী ছুঁয়েছে আকাশ। পৌছে গেছে পর্বত চুড়ায়। জয় করেছে খেলার মাঠ। রাজনীতির বিশেষ অঙ্গণে রয়েছে নারীর উপস্থিতি। কিন্তু নারীর এ এগিয়ে চলার পথে এখনো রয়েছে অনেক বাধা।
এখনও বাল্যবিবাহর মতো ঘটনা ঘটছে। সম্পত্তিতে এখনোও নারীরা পায়নি সমান অধিকার। একই পদে কাজ করেও থাকছে বেতন বৈষম্য। সিদ্ধান্তের জায়গায়তো এখনও সম্মান পাচ্ছে না নারীরা। তাহলে সমাধানটা কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী বিষয়ক আইন ও সংবিধান সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এ সংস্কারের মাধ্যমেই আইন ও সংবিধান অনুযায়ী নারীদেরকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
এ প্রেক্ষিতে সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন- সারাবাংলা থেকে খোঁজা হয়েছে সে বিষয়গুলো।
কর্মজীবী নারী সংগঠনের ডেপুটি ডিরেক্টর রাবিতা ইসলাম দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে- মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আইনের প্রয়োগ এবং অন্যটি শ্রম আইনের সংস্কার।
মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আইনের প্রয়োগ: সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির নির্দেশনা থাকলেও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় ৪ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি। সেখানেও আবার অনেকে বিনা বেতনে ছুটি কাটায়। কেউ আবার ফিরে এসে তার চাকরিটাই পায় না। স্বাধীন দেশে এমন বৈষম্য চাই না। এটা একই ফ্রেমে আনা যায় কিনা, সেটা দেখতে হবে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক, এটা সংস্কার প্রস্তাবনায় আসুক, সেটা আমাদের দাবি।
শ্রম আইনের সংস্কার: বাংলাদেশ শ্রম আইন যেটা আছে। সেই আইনে যৌণ হয়রানি সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো অস্পষ্ট। সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। যে আইন আছে, সেটাতে নারী সুরক্ষিত হয় না। যেসব আইনে নারীর অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে, সেগুলোর সংস্কার ও পরিবর্তন করা দরকার । আর এই আইন পরিবর্তন হলে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা শক্ত হতে পারে।
কর্মজীবী নারী সংগঠনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহানা তিথি আরও দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। সে দুটি হচ্ছে- সম্পত্তিতে নারীর অধিকার এবং নারী শ্রমিকদের স্বীকৃতি।
সম্পত্তিতে নারীর অধিকার: আইন অনুযায়ী পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলেদের তুলনায় নারীদের সম্পদের ভাগ কম দেয়া হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, এই নারী আবার তার স্বামীর সম্পতির ভাগ পাবে। আইন অমান্য করে সেই অংশটুকুও অনেক সময় দেয়া হয় না পরিবারের কন্যাটিকে। কিন্তু আবার আইন উপেক্ষা করে সমান অংশও দেয়া হয় না কোনো নারীকে। বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ নারী স্বামীর সম্পদের ভাগ পায় না। তাই সম্পত্তি ভাগে নারীদের জন্য সমান অধিকার এনে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
নারী শ্রমিকদের স্বীকৃতি: শ্রম আইন ২০০৬ ধারাতে নারী শ্রমিকদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। নারী শ্রমিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া উচিত। শ্রম আইন ধারাটিকে সংস্কার করে সেখানে নারী শ্রমিকদের স্বীকৃতি ইস্যুগুলো যুক্ত করা উচিত।

কর্মজীবী নারী সংগঠনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহানা তিথি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক ও কর্মজীবী নারী সংগঠনের ডেপুটি ডিরেক্টর রাবিতা ইসলাম – ছবি : সারাবাংলা
এদিকে উল্লেখিত দাবিগুলোর বিষয়ে কী আছে সংস্কার প্রস্তাবনায়?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক সারাবাংলাকে বলেন, সব ইস্যুকে নিয়ে আমরা প্রস্তাবনা তৈরি করছি। অন্তর্বর্তী সরকার নারীদের জন্য একটি সংস্কার কমিশন করেছে। এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্য। সেখানে আমাদের জন্য একটা সুযোগ রয়েছে যে, আমরা অনেক কিছু হাজির করতে পারবো। সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারবো।
তিনি জানান, বর্তমান, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি- এ তিন ধরনের সুপারিশ রাখা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাবনায়। যেসব সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব- সেগুলো বর্তমান মেয়াদি; আর যেগুলোর বিষয়ে বর্তমান সরকার ঘোষণা দিতে পারবে, কিন্তু বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নতুন নির্বাচিত সরকার- সেগুলো মধ্যমেয়াদি এবং অবশিষ্টগুলো দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিরিন পারভীন হক জানান, এছাড়া সুপারিশগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সংবিধান ও আইন সংক্রান্ত; নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিষয়ক।
তিনি জানান, সংবিধান ও আইন সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে- আর বৈষম্য নয়। বৈষম্যমূলক সব আইন এবং সংবিধানে যেগুলো বৈষম্যমূলক সাংঘর্ষিক আইন আছে- সেগুলো বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: কিছু নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোতেও কিন্ত বৈষম্য রয়ে গেছে। সেসব নীতিমালা সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তৃতীয়ত: প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগতভাবে নারীরা পিছিয়ে। কিন্তু নারীরা পিছিয়ে নয়, নারীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। ইচ্ছা করে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। নারীদের জায়গা দেয়া হচ্ছে না। পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এসব বঞ্চনার জায়গাগুলো শনাক্ত করে কীভাবে সমাধান করা যায়, সেগুলো যুক্ত করা হবে।
শিরিন পারভীন হক বলেন, ‘‘অবশ্য এগুলো রাতারাতি কার্যকর হবে না। ঘোষণা দিলেই যে, পরের দিন হয়ে যাবে তা নয়। এটা র্দীঘ প্রক্রিয়া। কারণ এটা শত শত বছরের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর ব্যপার। সুতরাং আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সুতরাং আইন ঘোষণা, নীতির পরিবর্তন, আইন জারি করে বা নীতি জারি করে হবে না। ব্যাপক আন্দোলন এবং ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “নারী আন্দোলনের স্বপ্ন, নারী আন্দোলনের কথা আমরা জনসম্মুখে নিয়ে আসতে চাই। আলাপ হোক, দ্বিমত হোক, বিতর্ক হোক, সমালোচনা হোক। তবুও জনসম্মুখে নিয়ে আসার এটাই সুযোগ। নারীরা কী চায়। কোনটা তাদের ন্যায্য হিস্যা। নানা প্রক্রিয়ায় জনসম্মুখে এই আলাপ হতেই থাকবে এবং এর মাধ্যমেই খন্ড খন্ড সংস্কার হতে পারে।”
অবহেলিত নারীদের কথা ভেবে বহু আগেই বেগম রোকেয়া বলেছিলেন,‘‘আমাদের কথা আমরা চিন্তা না করিলে আর কেহ আমাদের কথা ভাবিবে না। অতএব জাগো, জাগো হে ভগিনী।’’