বই আলোচনা
বিবিয়ানা— অভিমান, অবহেলা আর মায়ায় বোনা গল্প
১০ মার্চ ২০২৫ ০০:২৫
পুকুরের মাঝখান থেকে সোনার মোহরভরতি কলস উঠে এসেছে। রাত নামবে নামবে করছে। ঝিঁঝিঁপোকারা তৈরি হচ্ছে ডাকাডাকির জন্য। গোরুগুলো ফিরেছে একটু আগে। ঠিক এমন সময়ে কালামিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল পুকুরঘাটের পাশে। মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য ওযু করতে গিয়ে দেখতে পায়, পানির ভেতর থেকে ভেসে উঠেছে একটি কলসি। কলসির কলার কাছটা পেঁচিয়ে ধরে আছে বিষধর সাপ। দেখার সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে পালাতে যায় কালা মিয়া। প্রচণ্ড ভয় নিয়ে ঘাট পেরিয়ে সামনে যেতেই কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তার পরই অজ্ঞান। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
এই ঘটনার সঙ্গে শুরু হয়ে যায় কালা মিয়ার জীবনে নতুন ঘটনা। গ্রামে গ্রামে আর মানুষে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে পুকুরে মোহরভরতি কলস দেখেছে কালা মিয়া। কালা মিয়ার বাড়ির পুকুরে পানির নিচে জলকেলি খেলছে মোহরভরতি কলস। আর তাকে পাহারা দিচ্ছে সাপেরা। মুহূর্তে ফিসফিস। মোহরভরতি কলসের খোঁজে চেয়ারম্যানের তদারকি। আর সেইসঙ্গে আবদু ডাকাতের আগমন।
টানাপোড়েনের জীবনে পড়ে যায় কালা মিয়া। কালা মিয়া, গ্রামের সাদাসিধে কালামিয়া। স্ত্রী ফজিলাত এবং তাদের সন্তান রোখসানা, সৈকত মিলে একটি পরিবার। সংসারে অভাব নিত্য। তারপরও নানাকিছু খাওয়ার শখ পিছু ছাড়েনা তার। লোভাতুর জিহবা আর মন। কিন্তু স্ত্রীর কড়া শাসনে-শোষণে নাজোহাল কালা মিয়া। মনে মনে স্বপ্ন দেখে একদিন এই দুর্বিষহ জীবনের অবসান হবে। তার ভাই জালাল সবকিছুর অবসান ঘটাবে।
কিন্তু জালাল? কালা মিয়ার ছোটভাই জালাল পড়াশোনায় ছিলেন খুব ভালো। বাবা-মা মারা গেলে ছোট ভাই জালালকে পড়ালেখা করিয়ে বড় অফিসার বানায়। মেধাবী জালাল এখন শহরের বড় অফিসার, বসের মেয়ে সাভেরাকে বিয়ে করেছে। উপন্যাসের শুরুতে জালালকে আমরা দেখেছি বড়লোকের মেয়ে স্ত্রী সাভেরাকে নিয়ে ভুটানে হানিমুনে যেতে। ভুটানে বেড়ানোর একটা অংশ ছিল পুনাখ ফেস্টিভ্যাল। এই ফেস্টিভ্যালে পাহাড়ের ভাঁেজ ভাঁেজ জালাল দেখতে পায় মিনি স্টু পা। মৃত মানুষের কপালের হাড় দিয়ে বানানো হয় এগুলো। সাথে মেশানো হয় পাহাড়ের লাল মাটি। মৃত মানুষের আত্মা ঠিক সাতদিন পর এই স্টু পা তে ভর করে। আর এই স্টু পাতেই বসত গড়ে। আত্মীয়স্বজনরা এসে সেই স্টু পা তে এসে মায়ায় জড়াজড়ি করে সময় কাটায়।
ভুটানে বেড়ানো শেষ হয়। দেশে এসে সুখের পুতুল পুতুল সংসার যখন সাজাবে তখন সাভেরা জানতে পারে জীবনে ক্যানসারের উপস্থিতির কথা। রোখসানা-ফজিলাত-সৈকতের নিত্য অভাবে মোহরের সঙ্গে সঙ্গে কালবৈশাখির মত বিপদ আসে কালা মিয়ার জীবনে। আবদু ডাকাতের মারপ্যাঁচে জেল খাটতে হয় তাকে। জেলে পচে একসময় মারা যায় সে। ভাইয়ের সঙ্গে হয় না তার শেষ দেখা।
সাভেরা ক্যানসারের চিকিৎসা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকে চিরবিদায়ের। সাভেরাকে ভালোবেসে একবুক দুঃখ নিয়ে একেবারে গ্রামে চলে আসে জালাল। ভাই নেই। কিন্তু রাত হলে গোপনে ভাইয়ের কবর খুঁড়তে থাকে জালাল। লোকে হয়তো তাকে পাগল ভাবে। কিন্তু মিনি স্টু পা এর আত্মা তো সাতদিন পর ফিরে আসবেই। সেই প্রস্তুতি নেয় জালাল। ভাই কালা মিয়ার প্রতীক্ষায়…
এমন টানটান, মায়াময় জীবনের বুনন আমরা দেখতে পাই লেখক কিঙ্কর আহসানের বিবিয়ানা উপন্যাসে। বিবিয়ানা পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। এই গল্প অভিমান, অবহেলা আর মায়ায় ভরা। সেই মায়ার মোড়কে পাঠক আপনিও মুড়িয়ে নিতে পারেন নিজেকে। কিঙ্কর আহসানের বিবিয়ানা বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড থেকে। বইটির মূল্য ৪৫০ টাকা।
সারাবাংলা/পিটিএম